‘হিন্দি সিনেমা’ আনতে আপাতত বাধা নেই
বাংলাদেশে হিন্দি সিনেমা আমদানির পক্ষে ‘সম্মিলিত চলচ্চিত্র পরিষদ’ একাত্মতা প্রকাশ করায় তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে উপমহাদেশীয় সিনেমা আমদানির নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করতে সম্মত হয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। এ বছর ১০টি এবং আগামী বছর ৮টি হিন্দি সিনেমা (উপমহাদেশীয় ভাষা) বাংলাদেশে মুক্তি দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশে দুই ঈদ ও পূজার উৎসবে চলতে পারবে না কোনো বলিউড ছবি। সেন্সরের পাশাপাশি চলচ্চিত্র সম্মিলিত পরিষদের ছাড়পত্র নিতে হবে—এমন সব শর্তে এ দেশে আসতে যাচ্ছে উপমহাদেশের চলচ্চিত্র। গতকাল রোববার দুপুরে চলচ্চিত্র সম্মিলিত পরিষদের ব্যানারে সিনেমা সংশ্লিষ্ট ১৯ সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মিটিং করে এমন সিদ্ধান্তে সম্মতি দিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দীর্ঘ কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় কিছু শর্তসাপেক্ষে নির্দিষ্টসংখ্যক ভারতীয় হিন্দি ছবি আমদানির ব্যাপারে চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবাই একমত হয়েছেন, এজন্য তাদের অভিনন্দন। আমিও নির্দিষ্ট পরিমাণ আমদানির পক্ষে, অবাধ আমদানিতে আমাদের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতীতেও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমার কাছে ভারতীয় হিন্দি ছবি আমদানির দাবি উপস্থাপন করা হয়েছিল, পরে শিল্পী সমিতি আপত্তি জানিয়েছিল। সে কারণে আমি বারবার বলে এসেছি, সব সংগঠন একমত হয়ে বললে তখন আমরা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারব। এখন সেটি সম্ভব। প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করব, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরেও আনতে হবে।’
এর আগে সচিবালয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সম্মিলিত চলচ্চিত্রের পরিষদের নেতারা ‘নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিদেশি (উপমহাদেশীয় ভাষার) চলচ্চিত্র আমদানি ও মুক্তি প্রসঙ্গে’ একটি চিঠি তুলে দেন মন্ত্রীর হাতে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াৎ, শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ আক্তার ও সদস্য রিয়াজ, প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশীদ, সহসভাপতি মিয়াঁ আলাউদ্দিন, প্রযোজক পরিবেশক সমিতির পক্ষে খোরশেদ আলম খসরু ও মোহাম্মদ হোসেন, ফিল্ম ক্লাবের সভাপতি কামাল মোহাম্মদ কিবরিয়া এবং সম্মিলিত চলচ্চিত্র পরিষদের সদস্য সচিব শাহ আলম কিরণ।
সভায় কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াৎ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা আমাদের শর্তগুলো দিয়েছি, জানিয়েছি। আপাতত হিন্দি ছবি মুক্তি দিতে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। বিষয়টি এখন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে যাবে। এর পর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’
সিনেমা হল মালিক সমিতির পক্ষে সেই মিটিংয়ে ছিলেন মিয়াঁ আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রের ১৯ সংগঠন (সম্মিলিত চলচ্চিত্র পরিষদ) একমত হয়েছে যে, ভারতীয় ছবি আমদানি করা যাবে। তথ্য মন্ত্রণালয়ে এই মর্মে চিঠির মাধ্যমে আবেদন করা হয়েছিল। মন্ত্রী সেই আবেদন আমলে নিয়ে চলচ্চিত্রের ১৯ সংগঠনের সম্মতি চাওয়ায় হিন্দি ছবি আমদানির নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছেন। সবাই একটি সিদ্ধান্তে আসায় তিনি সাধুবাদ জানিয়েছেন।’
জানা যায়, ছবি আমদানি করতে হবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। তথ্য মন্ত্রণালয় তাদের কাছে ইচ্ছে পোষণ করে চিঠি দেবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি বিভাগ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। ছবিগুলো আনা কতটা লাভজনক, জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে কিনা—আমদানি নীতি অনুযায়ী তা খতিয়ে দেখবে। এতে সামাজিক, আইনি ও অর্থনৈতিক প্রভাবগুলো বিবেচনা করা হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ডলার সংকট বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। সে বিষয়টিও ভাবা হবে। এরপর আমদানি বিভাগের ইতিবাচক প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ছবি আমদানি করবে।
উপমহাদেশীয় ছবির কথা সামনে রাখলেও মূলত হিন্দি ছবি আমদানি নিষিদ্ধের পক্ষে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছেন সংগঠনগুলোর নেতারা। সম্প্রতি আলোচিত ছবি ‘পাঠান’ আমদানি করা নিয়ে পুরোনো আলোচনা নতুন মাত্রা পায়। এদিকে এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর বাংলাদেশে ‘পাঠান’ মুক্তিতে আর কোনো বাধা থাকছে না বলে মনে করা হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে যাচ্ছে শাহরুখ খান অভিনীত প্রায় হাজার কোটি রূপি ব্যবসা করা ছবিটি। বাংলাদেশে সিনেমাটি আমদানি করছেন নির্মাতা অনন্য মামুন। তিনি জানান, চিঠি পেলে তারা ছবি মুক্তি দিতে প্রস্তুত।
অন্যদিকে, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকেই ভারতীয় ছবির নিষেধাজ্ঞা ও অনুমতির খেলা চলেছে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তান সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র এদেশে (পূর্বপাকিস্তান) নিষিদ্ধ করে। আবার বাংলাদেশের জন্মের পর ১৯৭২ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ভারতীয় ছবি নিষিদ্ধ করা হয়।
আশির দশকে শেষ ও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কা যৌথ প্রযোজনা শুরু করে। এর অন্যতম নেতৃত্বে ছিল মধুমিতা সিনেমা। সে সময় দেশগুলোর বহু তারকাকে বাংলাদেশের পর্দায় পাওয়া যেত। তবে সার্কভুক্ত সবকটি দেশের বাণিজ্যিক পণ্য আদান-প্রদানের জন্য ২০০৪ সালের সাফটা চুক্তি হয়। এর আওতায় কলকাতার ভারতীয় ছবি এদেশে মুক্তি পেতে থাকে। কিছুদিন পর থেকে বলিউডের ছবি আমদানির দাবি বাড়তে থাকে।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে তিনটি বাংলাসহ ভারতীয় ১২টি চলচ্চিত্র আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়। আমদানি করা নয়টি হিন্দি ছবি হচ্ছে ‘শোলে’, ‘কাভি খুশি কাভি গাম’, ‘ডন’, ‘ওয়ান্টেড’, ‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘তারে জামিন পার’, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘দিলতো পাগল হ্যায়’ ও ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়।’
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ‘ওয়ান্টেড’ ছবির মুক্তি দেওয়া হলে কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় নামে চলচ্চিত্রের ১৯ সংগঠনের নেতারা। সে বিক্ষোভ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন—পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার, শিল্পী সমিতির সভাপতি শাকিব, সাধারণ সম্পাদক মিশা সওদাগর, আহমেদ শরীফ, অমিত হাসান, ওমর সানী, রুবেল, পরীমণি, অমৃতাসহ আরও অনেকে।
সরকার ভারতীয় ছবি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার দুদিনের মাথায় তা প্রত্যাহার করে নেয়।