রম্যগল্পঃ এম, এ হক

বউ খুব করে ধরলো তার সুন্দরী বান্ধবীর জন্য আমার অফিসে চাকরি ঠিক করে দিতে। বউয়ের বান্ধবী তো আমার সম্পর্কে শালি, অফিসের একজন নারীর পদও খালি। কাজেই ঢুকিয়ে দিলাম বসদের বলে কয়ে।

নিজের বউয়ের জন্য একই অফিসে চাকরি না চাওয়া গেলেও, দুর্সম্পর্কের শালির জন্য চাকরি চাওয়া যেতেই পারে। সে-ই শালি যদি অনিন্দ্য সুন্দরী, অবিবাহিত, করিৎকর্মা ও স্মার্ট হয় তাহলে তো কথাই নেই, অফিসের বস থেকে শুরু করে সহকর্মীরা পর্যন্ত আমার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকান।

চাকরি হওয়ার আগে বউয়ের বান্ধবী থাকতো মফস্বল এক শহরে। এই শহরে তার কেউ নেই। কাজেই আমাদের বাসাতেই প্রথম মাসটা থাকবে বলে বউই আমাকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো। আমার অবশ্য প্রথম প্রথম এ ব্যাপারে ঘোর আপত্তি ছিল, বউ চোখ রাঙিয়ে, মান-অভিমান করে একাকার। ‘আমার বান্ধবী থাকবে, তাই তোমার এতো গড়িমসি… নিজের বন্ধু বা বোন হলে তো দেখতে হতো না…’, ইত্যাদি ইত্যাদি ঘ্যানর ঘ্যানর ঘ্যান চলতেই থাকলো।

অবশেষে নাক-কান-গলা বাঁচাতে আমি রাজি হয়ে গেলাম বউয়ের বান্ধবী স্মিতা-কে আমাদের বাসায় রাখতে। অফিস টাইম এক বলে প্রতিদিন একসাথে বের হই।

এক বাসা থেকে একউ সময়ে দুজন তো আর আলাদা আলাদা যাওয়া যায় না। তাই স্মিতাকে নিয়েই রোজ সকালে বের হই, আবার ফিরিও। আবার যেহেতু আমাকে একা দুপুরের খাবার দেওয়া যায় না, তাই নিজের বান্ধবীর জন্যও খাবার দেয় বউ।

আমি আর স্মিতা প্রতিদিন অফিস ফেরার পথে নানা গল্প-গুজব করি, চুপচাপ মুখ গোমড়া করে তো আর আসা যায় না। বাসায় এসে সেসব গল্প আবার বউয়ের সামনেও করি, বউ পার্টিসিপেট করতে পারে না। অফিসের কজনকেই বা চেনে বউ যে পার্টিসিপেট করবে!

প্রথম কয়েকদিন মেনে নিলেও, একদিন সে সহসা রাগ দেখানো শুরু করলো। সেদিনের ব্যাপারটা এমন ছিল যে, আমাদের আফিস কলিগরা সবাই মিলে অফিস থেকে সিনেমা দেখতে যাবে। তো বউ ফোন দেয়ার পর আমি আর স্মিতা দুজনেই বললাম- আমাদের একটু দেরি হবে। কলিগরা সবাই সিনেমা দেখতে যাবো!

এর কিছুক্ষণ পর বউ ফোন দিয়ে বললো- সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, আমি যেন তক্ষুণি বাসায় চলে যাই। আর স্মিতাকে কিছু বলার দরকার নাই। সে সিনেমা দেখতে যাক।

আমি সিনেমা দেখা বাদ দিয়ে বাসায় ফিরে দেখি বউ দিব্যি সুস্থ হয়ে সেজেগুজে বসে আছে! ঢুকতেই বললো- সে দুটো সিনেমার টিকেট অনলাইনে কেটে রেখেছে, দেখবে বলে।

আমি খুবই বিরক্ত হলাম। বললাম- এসবের মানে কী?

এক কথায় দু-কথায় লেগে গেল। বউয়ের বাক্যগুলো এরকম ছিল-

আমি নাকি তার সুন্দরী বান্ধবীর প্রতি বেশি খেয়াল রাখি, তাকে কোলে করে অফিস নিয়ে যাই, আমি নাকি ইদানিং ওর চেয়ে স্মিতার প্রতি বেশি কেয়ারফুল হয়ে উঠছি…ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এই যে এখন যে আমার মেজাজ খারাপ সেটা নাকি স্মিতার সাথে সিনেমা দেখতে না পারার কারণেই!

বিপুল উদ্যমে দুজনই গলার সপ্তসুর চর্চা করলাম। সিনেমা দেখে স্মিতা ফেরার আগেই বউ শুয়ে পড়লো। আমি দরজা খুলে দিলাম। স্মিতা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলো না আমাদের মধ্যে তাকে নিয়ে কি বিশাল শব্দ ভাণ্ডারের বিপুল আদান-প্রদান হয়েছে।

স্মিতা মাস দেড়েক আমাদের বাসায় ছিল। তারপর কর্মজীবী হোস্টেলে উঠে গেল। এই মাস দেড়েকে আমি আর আমার বউ নিজেদের মধ্যে কথা বলেছি খুব কম। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, আমার বউ আমার মতোই ভদ্রলোক। কাজেই আমার দুজন স্মিতার সাথে ঠিকই হাসি ঠাট্টা করেছি।

অথচ অফিসে বের হওয়ার ঠিক আগে কিংবা অফিস থেকে ফেরার ঠিক পরে বউ একটা খোটা দিয়ে ঠিকই মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে। এই যেমন- ‘যাও যাও তাড়াতাড়ি ছোটো, আজ পাতলা শাড়ি পড়েছে… একটু বেশি করেই দেখো গা’, কিংবা ‘আজ যে খাবার ফেরত আসলো, গালে তুলে খাইয়ে দাওনি বুঝি’…

একটা-দুটা বাক্য, কিন্তু শরীরে আগুন ধরানোর জন্য যথেষ্ঠ।

স্মিতা চলে গেলে আমি ভেবেছিলাম সমস্যার সমাধান হবে; হলো বিপরীত। এখন যদি বলি, মিটিংয়ে তাও বউ ভাবে স্মিতার সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাচ্ছি। আবার যদি বাসায় ফিরতে দেরি হয়, তাও ভাবে স্মিতাকে এগিয়ে দিতে গিয়েছি।

সবচেয়ে ঝামেলা হলো, স্মিতা যেদিন বউকে ফোন দিয়ে বললো, হোস্টেলে খাবারের খুব সমস্যা, যদি সে টাকা শেয়ার করে, তাহলে আমার কাছে দুপুরের খাবারটা বউ রেঁধে দিতে পারবে কিনা!

এই আলোচনার ফল কী হতে পারে? আমি তো এসবের কিছুই জানিনা। সেই সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর দেখি বউয়ের চোখ ফোলা, গণপিটুনি খাওয়ার পর চোখ বুজে ছোট হয়ে গেলে যেমন হয় আর কি!

আমি স্বভাবতই উদ্বিগ্ন হলাম- বাড়ি থেকে ওর কোনও নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে এমনটা হয়েছে কিনা সেটা ভেবে। দরদ দিয়ে জানতে চাইলাম- কী হয়েছে?

বউ এমনভাবে ঢুকরে ‘কু’ করে কেঁদে উঠলো যে নিচতলা থেকে একটু নেড়ি কুকুরও তার দু:খের সাথে ‘উউউ…’ করে সাড়া দিল। আমি আর স্মিতা নাকি তাকে ‘বান্ধা-বুয়া’ বানাচ্ছি!

পরদিন আরেক কাহিনী, স্মিতা অনলাইনে একটা অরনামেন্টস অর্ডার দিয়েছে যেটা এসেছে- আমার নামে, আমার বাসায়। ছুটির দিন। আমি বাথরুমে ছিলাম। বউ সেটা রিসিভ করেছে। কী কী হতে পারে! না যেমন ভাবা যায় তেমন কিছুই হলো না। বউ খুব ঠাণ্ডা গলায় বললো- তুমি যে অরনামেন্টটা স্মিতার নামে অর্ডার দিয়েছিলে, সেটি এসেছে।

সেই সন্ধ্যায় আমি বউকে নিয়ে খুব আবেগঘন চেহারা করে বসলাম। যদিও আমার মেজাজ খুব তিরিক্ষে ছিল। কিন্তু অভিনয় করলাম, যেন আমি আসলে বিরাট অপরাধী।

বউকে বললাম- দ্যাখো, স্মিতার সাথে আমার তেমন কিছু নেই। তুমি যদি এরকম ভাবো অবশ্যই তাহলে আমার কিংবা ওর চাকরি ছাড়তে হবে। আমরা তো এক অফিসে চাকরি করি, কথা না বলে থাকা যায়? তার উপর আবার সে আমার শালি বলেই সবাই জানে।

বউ খুব অবলীলায় বলে ফেললো- আমি বড় না চাকরি?

আমি বললাম- মানে কী? তুমি কেন নিজেকে চাকরির সাথে তুলনা করছো?

‘তাহলে চাকরি ছেড়ে দাও ব্যস্’, বলে বউ টিভি ছেড়ে বসলো।

আমি তো অবাক। বললাম- স্মিতাকে চাকরি দিতে তুমিই বললে, আবার এখন শালির জন্য চাকরি ছাড়তে বলছো? আজব!

বউ টিভির দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই বললো- সব পুরুষের চরিত্রই এক। সুন্দরী মেয়ে, পা ফসকাতেই পারে। ক্ষমা তোমাকে করেই দিব, কিন্তু চাকরি ছাড়ো!

অগত্যা সে মাসেই আমার সংসার বাঁচাতে চাকরি খোঁজা শুরু করতে হলো। অবশেষে মাস তিনেক পর পেলামও। চাকরি না পেয়ে যে চাকরি ছাড়া যায় না, এটা বউকে বোঝাতে গলদঘর্ম হতে হতেই নতুন চাকরিটা পেলাম।

আবার নতুন করে আমার আর বউয়ের মধ্যে শান্তি ফিরে এলো। স্মিতাও আগের অফিসের এক কলিগের সাথে বেশ একটু প্রেমট্রেম করা শুরু করেছে। বউয়ের এখনো বদ্ধ ধারণা- আমার দিকেই নজর ছিল, আমি ওই অফিসে না থাকাতে ওই কলিগের সাথে জড়িয়েছে।

তারা দুইজন একদিন আমাদের বাসায় বেড়াতেও এসেছিল। বউ যতোটা খুশি হয়েছিল, সেরকম খুশি তাকে আমাদের বিয়ের দিনও দেখিনি!

মাস ছয়েক পর রাতে একদিন বই পড়ছি হঠাৎ বউ বইয়ের নিচ দিয়ে বুকের মধ্যে এসে আমার থুতনির সাথে মাথা রাখলো। তার মাথার মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে আসছে। আমি তার কানে একটা চুমু দিলাম।

বউ খুব আদুরে গলায় বললো- শোনো আমার একটা বান্ধবী আছে মিতা। খুউব সুন্দরী, ভালো মনের মেয়ে। ও সামনের মাসে ঢাকায় আসতে চেয়েছে, ওর জন্য একটা পাত্র দেখে দাও না প্লিজ…

আমি বউয়ের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই এতোটা জোরে এবং উত্তেজিত হয়ে ‘চোওওওপ’ বলে উঠলাম যে- ওর কানের থেকে ব্লিডিং শুরু হলো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর জানা গেল- পর্দা ফেটে গেছে।

ডাক্তার আমার কাছে জানতে চাইলেন কীভাবে ঘটেছে। ডাক্তারকে তো মিথ্যা বলতে হয় না। তাই বললাম- কানের কাছে বেশি জোরে চিৎকার করেছিলাম।

তিনি আমাকে বললেন, ছিহ আপনার লজ্জা করে না ভদ্রলোক হয়ে বউয়ের কানে চড় মারতে। আবার মিথ্যা বলতে!

এখন আমি কানে খাটো বউয়ের সাথেই সংসার করি। বউ ঠসা হলেও সংসারটা তো টিকেছে!

বিঃ দ্রঃ- ঘটনা‌টি কাল্প‌নিক।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *