প্রবীণদের প্রতি মানবিক হোক যুবসমাজ
বিশ্বে প্রবীণ জনগোষ্ঠী কমবেশি অবহেলিত। চূড়ান্ত পর্যায়ে কখনো অবহেলা-নিপীড়নের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। বয়স বেড়ে গেলে কেউ তাদের কাছে টেনে নিতে চায় না। কখনো কখনো বোঝা মনে করে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। পরমাত্মীয় এ সময় হয়ে যান পর বা দূরের কেউ। অর্থবিত্তহীন পরিবারের প্রবীণরা বড্ড বেশি অসহায়। শরীরে যতদিন শক্তি থাকে সারা দিন ঘাম ঝরিয়ে কোনোমতে দুবেলা অন্নসংস্থান করতে হয়। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে শেষ হয়ে যায় জীবনের সব আয়োজন। অর্থের অভাবে সন্তানের উপযুক্ত শিক্ষাদানও সম্ভব হয়ে ওঠে না বলে বড় হয়ে এসব সন্তান ইচ্ছে থাকলেও প্রবীণ মা-বাবাকে আর্থিক সহায়তা দিতে পারে না। আর সামর্থ্যবান সন্তানরা কখনো অবহেলা-অবজ্ঞার কারণে প্রবীণ পিতা-মাতার দেখভালের প্রয়োজনই মনে করে না। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে নিজের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে চায়। বাংলাদেশে প্রবীণদের রয়েছে অনেক দুঃখ-দুর্দশা আর বিড়ম্বিত জীবনচিত্র।
এই তো বেশিদিন আগের কথা নয়। নড়াইলের লোহাগড়ার অশীতিপর বৃদ্ধা হুজলা বেগম বাংলাদেশের বিশাল প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মর্মান্তিক জীবনের মূর্ত প্রতীক হয়ে রয়েছেন। মায়ের ভরণপোষণ দিতে না পারার অজুহাতে ৮৬ বছর বয়সী স্বামীহারা, তিন ছেলে ও দুই মেয়ের জননী হুজলা বেগমকে তার পুত্র ও পুত্রবধূ রাস্তা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে রাতে বাঁশবাগানে ফেলে রেখে যায়। খোলা আকাশের নিচে রাতভর পড়ে থাকা হুজলার ক্ষতবিক্ষত শরীর পিঁপড়া, পোকায় কামড়ায়। পরে তার স্থান হয় লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। অথচ এই মা তার চিরন্তন ভালোবাসা, অকৃত্রিম স্নেহ, মমতা দিয়ে কত দুঃখকষ্ট সহ্য করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন সন্তানের ভবিষ্যৎ, নিরাপদ করেছেন তাদের অনাগত আগামী। হুজলা বেগমের মতো আরও অনেকের বেদনাদায়ক জীবনের শোকগাথা রয়েছে আমাদের হৃদয়পুঞ্জিতে।
কেউ সহজে মরতে চায় না। সুন্দর এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে চায় না কেউ। কিন্তু দীর্ঘকাল যারা বেঁচে থাকেন, শেষ জীবন বেশিরভাগেরই কাটে বড় কষ্টে। আঠারো কোটি মানুষের এ বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা অনেক। কিন্তু বিত্তশালী প্রবীণের সংখ্যা হাতেগোনা। দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ প্রবীণই হয়ে পড়েন সহায়-সম্বলহীন। বাংলাদেশে ষাট বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষকে প্রবীণ ধরা হয়। সে হিসাবে দেশে এখন প্রবীণের সংখ্যা দেড় কোটি যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ। দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ার কারণে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ। বাংলাদেশের বিশাল প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশের আয়ের নির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নেই। পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ প্রবীণই দরিদ্র এবং ৪৮ শতাংশ প্রবীণের মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ্য নেই।
আগের দিনগুলোতে এ দেশের মানুষ বেড়ে উঠেছে যৌথ পরিবারে। মা-বাবা, ভাই-বোনের পাশাপাশি চাচা-চাচি, দাদা-দাদি নিয়ে থাকত বিশাল সংসার। পরিমিত খাওয়াদাওয়া, রুটিনমাফিক চলাফেরার মধ্যে বেড়ে উঠতে হতো সবাইকে। যৌথ পরিবারে ছিল স্নেহ-আদর-ভালোবাসা-শাসনের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। এরই মাঝে গড়ে উঠেছে একের প্রতি অপরের সহমর্মিতা। অন্যের জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। অনাবিল আনন্দে কখন কে বড় হয়ে গেছে টেরই পাওয়া যায়নি। বড় হয়ে চাকরি পেয়ে বেতনের টাকা থেকে বাবা-মায়ের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দায়িত্ব-কর্তব্যবোধের তাড়না অনুভব হতো। সম্ভব হলে তাদের কাছে রেখে যত্ন, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে চাইত মন। একান্নবর্তী পরিবারে প্রবীণদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক। পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থায় ও আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে এসব আজকাল যেন স্বপ্ন হয়ে গেছে।
দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, চাকরিগত ও অন্যান্য পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাঙালির ঐতিহ্যমণ্ডিত সময়টা যেন দ্রুত পাল্টে গেল। বিশ্বায়নের এ যুগে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে গড়ে উঠেছে একক পরিবার। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন আত্মীয়-পরিজন। মূল্যবোধের করুণ অবক্ষয়ে পরিবারগুলো থেকে প্রবীণরা ছিটকে পড়েছেন। সন্তানের মায়ার বাঁধন ছেড়ে পড়ে গেছেন আলাদা এক অনিশ্চিত ভুবনে। সেখানে আছে শুধু অনিশ্চয়তা, দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা। যাদের অর্থ আছে তারাও সুখে নেই। তাদের রয়েছে সীমাহীন নিঃসঙ্গতার দুঃসহ যন্ত্রণা, একাকিত্বের ভয়ংকর বোঝা। বার্ধক্যকালীন মানুষের জীবনে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে। আর এ পরিবর্তনই তাদের মাঝে এনে দেয় সামগ্রিক অসুস্থতা। আর এ অসুস্থতার কারণে সৃষ্ট শারীরিক অসমর্থতা তাকে অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে।
বর্তমান সমাজ-সংসারে প্রবীণরা অনেক ক্ষেত্রে বিবেচিত হচ্ছেন বোঝা হিসেবে। সচ্ছল সন্তান থাকা সত্ত্বেও হতভাগা কোনো প্রবীণকে ভিক্ষা করে জীবন কাটাতে হচ্ছে। কারও স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সচ্ছল এবং দরিদ্র উভয় শ্রেণির প্রবীণদের নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্ব অর্থনীতির জন্য প্রবীণ জনগোষ্ঠী এক বিশাল ঝুঁকি। তারা দেশ ও সমাজকে কিছু দিতে পারে না, অথচ তাদের জীবন-যন্ত্রটিকে চালানোর জন্য জ্বালানির তো দরকার। প্রবীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা অধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তাদের জন্য স্বল্পশ্রমের উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে আর্থিক সংকট দূর করা যেতে পারে। তাতে তাদের কর্মব্যস্ততার মাঝে মনের খোরাকও মিলবে। আর এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় প্রবীণদের পরিবারের সবার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। প্রবীণদের আর্থসামাজিক অবস্থান সব ধরনের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রবীণদের পরিবার ও সমাজে অবহেলিত, উপেক্ষিত এবং বঞ্চনার শিকার হতে হয়।
আমেরিকা, ইউরোপের মতো উন্নত দেশে অনেক আগেই ‘ওল্ড হোম’ চালু হয়েছে। আজ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর ছাড়িয়ে মফঃস্বল শহরেও বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। আশ্রয়হীন, স্বজনবিহীন প্রবীণদের শেষ ভরসা এসব বৃদ্ধাশ্রম। উৎসব-পার্বণের দিনগুলোতে এসব প্রবীণকে দেখানো হয় টেলিভিশন প্রোগ্রামে। এদের অনেকের সন্তানই বড় চাকরি কিংবা ব্যবসা করে। একই শহরে থেকেও সেখানে বাবা-মাকে সঙ্গে রাখতে চায় না। তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে, বাবা-মায়ের ব্যয়ভার বহন করে দায়িত্ব পালন করতে চায়। মা-বাবাকে সন্তানের কাছে রাখার আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়াও প্রবীণ মা-বাবার বার্ধক্যের দায়িত্ব গ্রহণ, তাদের যথাযথ সম্মান ও নিরাপত্তা দেওয়া সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। পরিবারে প্রবীণ মা-বাবার অবস্থান সুদৃঢ় করা, মর্যাদা সমুন্নত রাখা সন্তানেরই একান্ত কর্তব্য। এ দায়িত্ব-কর্তব্যটি পালন করতে হবে একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে। তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, উন্নত পরিবেশে বসবাস, উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদানের দায়ভার সন্তানকে নিতে হবে। পারিবারিক সিদ্ধান্তে প্রবীণদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবারের ছেলেমেয়েদের শৈশবকাল থেকেই গুরুজনকে ভক্তি, শ্রদ্ধা করার শিক্ষা দিতে হবে। পরিবারে নবীন, প্রবীণ সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার বাঙালি সমাজজীবনের যে চিরন্তন ঐতিহ্য তা ধরে রাখতে হবে যাতে আগামীতে কোনো প্রবীণকেই আর বৃদ্ধাশ্রমে যেতে না হয়।