কৃত্রিম বুদ্ধির চ্যাট জিপিটি : শঙ্কা ও সম্ভাবনা

কেউ এটিকে ব্যবহার করে কবিতা লিখিয়ে নিচ্ছেন, কেউ রচনা লেখাচ্ছেন, কেউ আবার ওয়েবসাইট পর্যন্ত বানিয়ে ফেলছেন। কেউ নিচ্ছেন নানা রকম প্রশ্নের উত্তর। শুধু একটি কমান্ড দিলেই হলো। এখন পর্যন্ত বিনামূল্যে ব্যবহারের সুবিধা নিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপেন প্ল্যাটফর্ম চ্যাট জিপিটি তাই টেক দুনিয়ায় আলোচনরা শীর্ষে। প্রথম দুই মাসের মধ্যে দৈনিক ১৩ মিলিয়নেরও বেশি দর্শক এবং ১০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে নতুন এই প্রযুক্তির।
শুধু তাই নয়, এই ওপেন-সোর্স প্ল্যাটফর্মটি অবিশ্বাস্যভাবে মাত্র ৫ দিনে এক মিলিয়ন ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছেছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেনি। নেট ফ্লিক্স প্রথম ১ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছতে ৫ বছর সময় নিয়েছে, ফেসবুকের লেগেছে ১০ মাস আর স্পটিফাইর লেগেছে ৫ মাস। এই পরিসংখ্যানেই বোঝা যায়, চ্যাট জিপিটি কতটা আগ্রহ তৈরি করেছে ব্যবহারকারীদের মধ্যে।
তবে এই আগ্রহের কারণ শুধু মুহূর্তে তাকে দিয়ে নানা রকম কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেক শঙ্কা, বিতর্ক, আর মানব বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বেগ। আছে বিশ্বব্যাপী নানা পেশার কোটি কোটি মানুষের চাকরি বা কাজ হারানোর উদ্বেগ। আছে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা নষ্ট করে দেওয়া বা পড়ার ধরন বদলে দেওয়ার মতো চিন্তা।
বলা হচ্ছে, চ্যাট জিপিটির কারণে ৭৫ মিলিয়ন মানুষের চাকরি হুমকির মুখে পড়বে। বর্তমান বিশ্ব তার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্যে আছে, যেখানে মানব শ্রমের চেয়ে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চলা কোম্পানিগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা রকম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানুষ হিসেবে আমরা কীভাবে এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াব, সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে আসছে বিশ্বের সামনে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের চাকরির ভবিষ্যৎ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে শ্রমঘণ্টার মানুষের অংশগ্রহণ ৭১% থেকে কমে ৫৮%-এ নেমে আসবে। মেশিন এবং অ্যালগরিদমের অবদান বেড়ে যাবে প্রায় ৫৭%। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নানা প্রচলনের কারণে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ ২০২৫ সালের মধ্যে চাকরি হারাবে বা কাজ বদল হবে। তবে সেখানে নতুন আশার খবরও আছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই প্রযুক্তি চালুর ফলে ১৩৩ ধরনের নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। যেমন–ডেটা বিশ্লেষক, প্রযুক্তি বিজ্ঞানী, এআই এবং মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ। এই প্রযুক্তির নানা রকম পরিষেবা দেওয়ার জন্যও মানুষ প্রয়োজন হবে, যেখানে নতুন চাকরির বাজারও তৈরি হবে নিশ্চয়ই। এ জন্য নিজেকে প্রযুক্তিদক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প থাকবে না।
এবার আসা যাক মানব সত্তার অস্তিত্ব বিষয়ে। অনেকেই শঙ্কার মধ্যে পড়ে গেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যদি একজন লেখকের লেখা তৈরি করে দেয়, ছাত্রদের হোমওয়ার্ক তৈরি করে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয় গবেষকের গবেষণা কাজটি করে ফেলে–তাহলে মানুষের চিন্তার জগতে বড় ধরনের ভাটা পড়বে। মানুষের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে। চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। আসলেই কি তাই? আপনি কি চ্যাট জিপিটিকে এই প্রশ্নটি করেছেন যে, সে আসলে কে? এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে? চ্যাট জিপিটি কি মানবতার জন্য আসলেই হুমকি হবে?
এই ধরনের প্রশ্নে চ্যাট জিপিটির উত্তর হলো, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি একটি এআই ভাষার মডেল হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি বা প্রেরণা নেই। আমি যে তথ্যের ওপর প্রশিক্ষণ পেয়েছি তার ওপর ভিত্তি করে কোনো উত্তর তৈরি করি এবং সহায়ক প্রতিক্রিয়া প্রদান করার জন্য আমি প্রোগ্রামিং করেছি। আমি মানবতার জন্য হুমকি নই, কারণ আমার স্বাধীন চিন্তা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমার উদ্দেশ্য হলো তথ্য প্রদান এবং আমার ক্ষমতার সেরা কাজটি সম্পন্ন করার মাধ্যমে মানুষের জীবনকে আরেকটু সহজ করে তোলা।’
মিনেসোটা এবং পেনসিলভানিয়ার ওয়ারটন স্কুল অব বিজনেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা সম্প্রতি আইন এবং ব্যবসায়িক পরীক্ষায় পাস করার জন্য চ্যাট জিপিটির সক্ষমতা যাচাই করেছেন। বি এবং সি গ্রেড পাওয়ার জন্য মামলাগুলোতে আইন প্রয়োগ করার জন্য যে ধরনের যুক্তি একজন আইনজীবী উপস্থাপন করতে পারেন, সেটা করতে পারেনি চ্যাট জিপিটি। তাকে ভালো উত্তর দেওয়ার জন্য বারবার মানুষের নির্দেশনা নিতে হয়েছে। পারফর্ম করার সময় মৌলিক গণিতে ‘বিশাল’ ভুল করেছে চ্যাট জিপিটি। ফলে এটি পরিষ্কার যে, এটি স্বাধীনভাবে একটি কাজ করার ক্ষমতার পরিবর্তে সহযোগী হাতিয়ার হিসেবেই বেশি উপযুক্ত। চ্যাট জিপিটি আসলেই মানুষের প্রয়োজন কমে যাবে, পেশা থাকবে না এমন ভাবার সময় এখনো আসেনি।
চ্যাট জিপিটি আসার পর সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো গুগলের কী হবে? গুগল কি হুমকিতে পড়বে? গুগলের যে সার্চ ইঞ্জিন আছে তা কি দরকার পড়বে ভবিষ্যতে? গুগল নিজেও এখন এটি নিয়ে চিন্তিত এবং তারাও নিজেদের মতো করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এইআই নিয়ে নতুন কিছু করার চিন্তা করছে। গুগল নিজেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই মাধ্যমকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করছে এবং ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে যে তারা CALM নামে নিজস্ব টেক্সট-টু-টেক্সট সমাধান তৈরিতে কাজ শুরু করেছে। জি-মেইলের অন্যতম প্রবর্তক পল ব্লুচেইট এরই মধ্যে বলেছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে বর্তমান সার্চ ইঞ্জিনগুলোর জায়গা দখল করে নিতে পারে চ্যাট জিপিটির মতো এইআই প্রযুক্তিগুলো।
তাহলে কি বিশ্বের অন্যান্য টেক বিজনেস, সেগুলোতেও বড় ধাক্কা দেবে চ্যাট জিপিটি। তেমনটা ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারণ, প্রযুক্তির ধর্মই হলো নতুন এলে পুরোনোটি সরে যেতে বাধ্য। তবে এআই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এখনই সব বলা যাচ্ছে না। কারণ, এটি এখন পর্যন্ত যে পর্যায়ে আছে তাতে মানুষের আস্থা পেতে আরও সময় লাগবে। বিশেষ করে গুগল সার্চে মানুষ যেভাবে নানা বিষয়ে রেফারেন্সসহ উত্তর পেয়ে যায়, তা মানুষের মধ্যে একটা আস্থার জায়গা তৈরি করেছে। আর চ্যাট জিপিটি গ্রহণ করা নিয়ে নানা ধরনের উদ্বেগও আছে। আছে নানা বিতর্ক।
তবে বর্তমানে চ্যাট জিপিটি তৃতীয় সংস্করণে আছে। এআই-এর কম্পিউটেশনাল শক্তি সম্পর্কে ধারণা পেতে প্রথম সংস্করণটি ৭ হাজার বই দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, দ্বিতীয় সংস্করণটি ৮ মিলিয়ন নথি দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এবং তৃতীয় সংস্করণে উইকিপিডিয়া ও বইসহ ৪৫ টেরাবাইট ডেটা ব্যবহার করা হয়েছিল। এই সংস্করণে ১৭৫ বিলিয়ন প্যারামিটার রয়েছে, যা দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে প্রায় ১০০ গুণ বেশি। আর বাজারে আসার অপেক্ষায় থাকা চতুর্থ সংস্করণটি হবে তৃতীয় সংস্করণের তুলনায় প্রায় ৫০০ গুণ বেশি শক্তিশালী। ফলে সে সময় এই প্রযুক্তি আর কী কী করে ফেলে, তা দেখার অপেক্ষায় দুনিয়া। বলা হচ্ছে, এটি হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার।
অতীতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন শ্রম-নিবিড় এবং বারবার করতে হয়–এমন কাজগুলোকে প্রতিস্থাপন করেছে। কিন্তু প্রযুক্তি সব সময় সৃজনশীল, বিশ্লেষণাত্মক এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা প্রয়োজন–এমন চাকরির বাজারও তৈরি করেছে। প্রযুক্তি কাজগুলোকে সহজ করেছে, উৎপাদনশীলতাকে উন্নত করেছে এবং সবার কাছে সুবিধা ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে, উৎপাদেনের মূল কাজটা কিন্তু মানুষকেই করতে হয়েছে। নতুন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হয়তো মানুষের কাজ কমিয়ে দেবে, কিন্তু আসল কাজটা মানুষকেই করতে হবে। যারা পেশা হারানোর ভয়ে আছেন তাদের বলি, প্রযুক্তি কখনো মানুষের চিন্তাশক্তির বিকল্প নয়। চিন্তাশক্তিই মানুষকে আর সবকিছু থেকে আলাদা করেছে। সেই চিন্তা দিয়েই মানুষ করবে নতুন কিছু, গড়বে নতুন কিছু। আর প্রযুক্তি হবে মানুষের সহায়ক শক্তি। মূল শক্তি নয়।
শেষে প্রশ্ন হলো, আমরা কতটা প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিশেষ করে চ্যাট জিপিটির মতো প্রযুক্তিকে কাজে লাগনোর ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব নীতিমালা করা জরুরি হবে। যেহেতু এই প্রযুক্তিকে পাশ কাটিয়ে চলা সম্ভব নয়। তাই এটিকে ব্যবহারে গাইডলাইন ও সতর্কতা জরুরি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে ঘিরে প্রযুক্তির ব্যবহার কীভাবে হবে–তার ব্যাপারেও এখন থেকেই পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। আবার সমাজে এই ধরনের প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে এখন থেকেই প্রস্তুতি জরুরি।