পদত্যাগ বনাম পিটাপিটি


১৫ জানুয়ারি স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার (অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী বা চিফ মিনিস্টার) নিকোলা স্টার্জন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। না, কোনো আন্দোলনের মুখে নয়, কোনো পদত্যাগের দাবির মুখেও নয়। হ্যাঁ, কিছু রাজনৈতিক চাপ বা দাবি স্কটল্যান্ডেও আছে। যেমন জেন্ডার বিল এবং স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের আয়োজনে ব্রিটিশ সরকারকে রাজি করানো। কিন্তু সেগুলো নিয়মিত বিষয়, পদত্যাগ করার মতো কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। তার দল স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টিতেও এমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই যে দলের অভ্যন্তরে চাপ আছে। স্রেফ তার মনে হয়েছে যে পদত্যাগ করার এটাই উপযুক্ত সময়। ঘোষণা দেওয়ার সময় তিনি বলেছেন, ‘আমার মস্তিষ্ক এবং মন বলছে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার এটাই সময়।’ বলেছেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষণটি থেকেই আমি বিশ্বাস করেছি, অনেকটা সহজাতভাবেই উপযুক্ত সময় এলেই অন্য কারও জন্য পদটি ছেড়ে দিতে হবে। এবং সময় যখন এলো তখন আমি সাহসের সঙ্গেই কাজটি করলাম। যদিও আমার দল এবং দেশবাসীর অনেকেই মনে করছেন আমি পদত্যাগ খুব আগেভাগেই (too soon) করছি।’ তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গি আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ফার্স্ট মিনিস্টারকে সর্বক্ষণ ডিউটি পালন করতে হয়। একজন সাধারণ স্টাফ যেমন বন্ধুদের সঙ্গে কফি শপে যেতে পারেন অথবা হাঁটতে যেতে পারেন, সেটা ফার্স্ট মিনিস্টারের পক্ষে অসম্ভব। আমিও তো মানুষ।’ স্টার্জনের এ পদত্যাগের ঘোষণা ব্রিটেনসহ ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত।

এমনিভাবে এক মাস আগে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ্যারডার্ন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে নিউজিল্যান্ডসহ সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন। তিনি তার পদত্যাগের ঘোষণাকালে বলেছিলেন, ‘আমি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছি, কারণ এ পদে থাকলে জানতে হয় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কখন তুমি সঠিক ব্যক্তি এবং কখন সঠিক নও। আমিও একজন মানুষ, রাজনীতিবিদরাও মানুষ। আমরা যতক্ষণ পারি, ততক্ষণ সর্বোচ্চ দিয়ে করতে পারি। আমার জন্য এটাই সময়।’

ব্রিটেনে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অল্প সময়ের মধ্যে আমরা দেখেছি বরিস জনসন, থেরেসা মে এবং লিজ ট্রাসকে পদত্যাগ করতে। তাদের পদত্যাগ রাজনৈতিক সংকটের মুখে হলেও ছিল না কোনো জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ বা নিহত হওয়ার ঘটনা। তারা প্রত্যেকেই কনজারভেটিভ দলের সদস্য। বিরোধী লেবার পার্টি এ ক্ষেত্রে শুধু ভালোমন্দ বিবৃতির মধ্যেই থেকেছে।

পক্ষান্তরে ‘মুদ্রার অন্য পিঠে’ আমরা ভিন্ন চিত্রই দেখেছি, দেখছি। ২০১০ সালে তিউনিসিয়ায় দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে লিবিয়া, মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়া, বাহরাইন, আলজেরিয়া, লেবানন, জর্ডানসহ প্রায় সবকটি মধ্যপ্রাচ্যের ও উত্তর আফ্রিকার দেশে। যেসব দেশে আন্দোলন সফল হয়েছে সেসব দেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে হয় দীর্ঘকালের শাসকের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে, অথবা কোনোক্রমে পালিয়ে জীবন রক্ষার মধ্য দিয়ে। যেমন তিউনিসিয়ার জইন এল আবিদিন বেন আলি। ১৯৮৭ সাল থেকে তিউনিসিয়ায় ক্ষমতায় ছিলেন। তিউনিসিয়ায় মূল্যস্ফীতি ও করাপশনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়েছিল দেশটি। এরই মধ্যে সিদি বাউজিদ শহরে এক ঠেলাগাড়িতে সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বাউজিজির কাছে পুলিশ রাস্তায় বিক্রির অনুমতি না থাকার অজুহাতে উৎকোচ দাবি করলে তিনি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। সিদি বাউজিদ শহরে যে আন্দোলন শুরু হয় তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। হত্যা, নির্যাতন, জরুরি অবস্থা জারি কোনো কিছুতেই সে আন্দোলন থামানো যায়নি। অবশেষে বেন আলি লিবিয়ার সহায়তায় পালিয়ে প্রথমে মাল্টায় এবং পরে সৌদি আরবে গিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু প্রায় একই সময়ে শুরু হওয়া আন্দোলনে মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক পালাতে পারেননি। প্রথমে গৃহবন্দি তারপর জেল, এসবের মধ্য দিয়েই ২০২০ সালে তিনি ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তবে সবচেয়ে নিষ্ঠুর পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে লিবিয়ায় ১৯৭৯ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে। যে গাদ্দাফির নামোচ্চারণও লিবিয়ায় অসম্ভব ছিল, তাকে আন্দোলনের মুখে পালিয়ে যাওয়ার সময় পিটিয়ে, চাকু দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে লিবিয়ার জনগণ। ‘আরব বসন্ত’ আজও শেষ হয়নি। করুণ পরিস্থিতি আমরা আজও দেখতে পাচ্ছি সিরিয়া ও ইয়েমেনে। সিরিয়ায় বাশার সরকারকে মদত দিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলের একটি গোষ্ঠী আর ক্ষমতাচ্যুত করতে আরেকটি গোষ্ঠী। একজন মাত্র মানুষের ক্ষমতায় থাকা না থাকাকে কেন্দ্র করে সিরিয়ায় এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু পরিচয় নিয়ে দেশ থেকে পালিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। কিন্তু ক্ষমতা ছাড়েননি আসাদ।

আমরা শ্রীলঙ্কায় দেখলাম অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে পালিয়ে বাঁচতে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে চলছে রাজনৈতিক সহিংসতা। প্রেসিডেন্ট পেদ্রো কস্টিলাকে অভিশংসনের চেষ্টার সময় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে এবং কিছু আইনের সংস্কার করতে চাইলেন। কিন্তু পার্লামেন্টারিয়ানদের বিরোধিতার মুখে অবশেষে তারা তাকে অভিশংসিত (ইমপিচমেন্ট) করলেন। পালিয়ে মেক্সিকো দূতাবাসে আশ্রয় নিতে চাইলেও তিনি তা পারলেন না। এখন তিনি মামলার আসামি এবং এমন সব মামলা যে, অন্তত ২০ বছর কারাদণ্ড হতে পারে।

এই যে তৃতীয় বিশ্বে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা ক্ষমতা ছাড়তে চান না এবং ছাড়লে জীবন ঝালাপালা হয়ে যায় এর কারণ বহুবিধ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দেখা যায়, যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা সরকারের আইনগত ক্ষমতাকে টাকায় রূপান্তর করেন, ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে লাভবান হন। ফলে বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার অবস্থা হয়। ক্ষমতায় যখন থাকেন তখন মানুষ গুঞ্জন করে, প্রশাসন গোয়েন্দারা হিসাব কষতে থাকেন। যে-ই ক্ষমতা থেকে সরে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অনিয়মগুলোর ঠিকুজি বের হয়ে আসে। আবার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই প্রতিহিংসাপরায়ণতাবশত বিভিন্ন মামলা দাঁড় করিয়ে জেল-জরিমানা নিশ্চিত করা হয়। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যাদের বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসলে উঠেছে, ক্ষমতা থেকে তাড়িয়েছে, তারা এবং তাদের প্রত্যেকের পরিবার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক। আর এ অর্থের একমাত্র উৎস ক্ষমতা।

প্রাসঙ্গিকভাবেই বলতে হয়, শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে একমাত্র বিএনপির ক্ষমতার পিপাসা ছাড়া সাধারণ মানুষের কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম নেই। বাংলাদেশের কোথাও দেখা যাবে না যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া সাধারণ কোনো মানুষ প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে। এর প্রধান কারণ হলো, তিনি তার ব্যক্তিগত ইমেজকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পেরেছেন। দলের অন্য কিছু লোক যা-ই করুক। ইউটিউবে কিছু স্বার্থান্বেষী এবং দুষ্টলোকের ভেক কথা ছাড়া সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির কোনো অভিযোগ কেউ আনতে পারেনি। পানামা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স, প্যানডোরা পেপার্সসহ যত ফাঁস হওয়া গোপন তথ্য বের হয়েছে তার কোথাও প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বা তার সন্তানদের নাম প্রকাশ পায়নি। ফলে তিনি যেমন তার মনোবল ধরে রাখতে পেরেছেন, তেমনি জনগণও শতকষ্টের মধ্যেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জন্য অস্থির হয়ে ওঠেনি। বিএনপি নেতারা প্রায়ই মানুষকে রাস্তায় নামতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টায় বলে থাকেন, ‘মানুষ জেগে উঠেছে।’ মানুষের জেগে ওঠা কাকে বলে তা জেনেও বিএনপি নেতারা এ অসত্য কথা বলে থাকেন। বাংলাদেশের মানুষ জাগলে তার চেহারা হয় কী রকম—তা আমরা বারবার দেখেছি। আমরা ১৯৭১ সালে জেগে উঠতে দেখেছি, ’৯০-এ সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর সময় জেগে উঠতে দেখেছি, যখন ট্যাঙ্কের সামনেও মানুষ বুক পেতে দিয়েছে; ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া তথা বিএনপির ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনমূলক নির্বাচনের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে দেখেছি, যে নির্বাচন ঠেকাতে শতাধিক মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। সাধারণ মানুষ এখন কষ্টে আছে, কথা সত্য। তবে সে কষ্ট যে বৈশ্বিক এবং কারও হাতে নেই সে কথা বাংলাদেশের জনগণ খুব ভালো করেই জানে!


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *