ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা
এম,এ হক
যার দান করা ৬০০ একর জমির উপর দাড়িয়ে আছে আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল , বুয়েট সেই নবাব স্যার সলিমুল্লাহর আজ মৃত্যুবার্ষিকী। যদিও তিনি জীবদ্দশায় এই বিশ্ববিদ্যালয় দেখে যেতে পারেননি।
নবাব সুলিমুল্লাহর জন্ম ১৮৭১ সালের ৭ ই জুন। তাঁর বাবা ছিলেন নওয়াব স্যার খাজা আহসানউল্লা (১৮৪৬-১৯০১) এবং দাদা ছিলেন নওয়াব স্যার খাজা আবদুল গণি (১৮১৩-৯৬)। এই দুজনই ঊনবিংশ শতকের বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তখনকার সময়ের অভিজাত ও ধনাঢ্য পরিবার। কিন্তু অভিজাত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের দুঃখকে নিজের দুঃখ মনে করতেন। তিনি আকাতরে দান-খয়রাত করে গেছেন।
স্যার সলিমুল্লাহর বাবা আহসানউল্লা ১৯০১ সালের ৭ই ডিসেম্বর সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ করে ঢাকায় তথা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন, প্রথম বিজলি বাতির আলো জ্বলেছিল আহসান মঞ্জিলে।
নবাব সলিমূল্লাহ সেই যিনি সর্বপ্রথম পানীয় জল এবং টেলিফোন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে আধুনিক ঢাকার জন্ম দেন।
ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯০২ সালে তিনি ১লাখ ২০হাজার টাকা দান করেছিলেন। সেই টাকায় এবং তাঁর দান করা জমিতে স্থাপিত হয়েছিল আহসানউল্লা স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৯২২ সালে যা আহসানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ১৯৬০ সালে আহসানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে উন্নীত হয়। যা এখনকার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়(BUET) নামে পরিচিত।
নবাব সলিমূল্লাহ যিনি ১৯০৩ সালে বড় লাট লর্ড কার্জন ঢাকায় সফরে এলে আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ বৈঠকে তার নিকট পূর্ব বাংলার সমস্যাগুলো তুলে ধরেন।শেষ পর্যন্ত ঢাকাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠনের বিষয়ে ইংরেজরা মত দেয়।
নবাব সলিমূল্লাহ যিনি ১৯১১ সালের ২৯শে আগস্ট ঢাকার কার্জন হলে ল্যান্সলট হেয়ারের বিদায় এবং চার্লস বেইলির যোগদান উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নওয়াব আলী চৌধুরীকে নিয়ে পৃথক দুটি মানপত্র নিয়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জমিই শুধু দান করেননি, প্রধান অর্থদানকারীও ছিলেন। এতে তাঁর অর্থভাণ্ডারে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। শেষে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মহাজনদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল। জমিদারী চলে গিয়েছিল কোর্ট অব ওয়ার্ডসে।
নবাব সলিমূল্লাহর আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক শিক্ষা বিভাগে মুসলমানদের জন্য সহকারী পরিদর্শক ও বিশেষ সাব ইন্সপেক্টরের পদ সৃষ্টি করা হয়।
নবাব সলিমূল্লাহ বর্ণবাদী- হিন্দু বাহ্মণদের চক্রান্ত নস্যাৎ করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সামাজ্যবাদে শত বছরের অধিক চাষাভূষা, কচোয়ান-দারোয়ান ও গোলাম বানিয়ে রাখা মুসলিমদের কথা ভেবে প্রথম প্রতিবাদী হয়ে উঠেন এবং তারপর মুসলিমদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন।
নবাব সলিমূল্লাহ ১৯০৬ সালে নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য এবং ধর্ম রক্ষায় প্রায় ছয় মাসের প্রচেষ্টায় পাক-ভারত উপমহাদেশে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ গঠন করেন।
নবাব সলিমূল্লাহ সুদূর তুরস্কের ভূমিকম্পে মানুষের কষ্টের কথা শুনে সাহায্যের জন্য টাকা-পয়সা পাঠিয়েছিলেন।
নবাব সলিমূল্লাহ মানুষকে তার সকল সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে ঋণী হয়েছিলেন। সোনালী ব্যাংক সদরঘাট শাখায় এখনও তার বন্ধক রাখা সিন্ধুক “দরিয়ায়ে নূর” রক্ষিত আছে।
আমরা ক’জন জানি এই মহান ব্যক্তির কথা? তার অসামান্য কীর্তির কথা?
এই বুয়েট না থাকলে কারা বিশ্বমানের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ করে দিত?
আজ যত-শত আবর্জনার মাঝেও আমাদের জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাড়িয়েছে যেখানে, সেখানে এই মহান ব্যক্তিদের একটু জায়গা কোথায়। আজকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় “রবীন্দ্র জয়ন্তী” পালিত হয়, যে রবীন্দ্রনাথ নিজে আর তার সাম্প্রদায়িক সম্প্রদায় চায়নি ঢাকায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হোক।
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ’র মৃত্যু প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদরা বলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে বড়লাট এবং বর্ণবাদী হিন্দুদের সঙ্গে নবাবের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে বড়লাট নবাবকে অপমানজনক কথা বলেন। যা তার সহ্য হয়নি। নবাবের সঙ্গে সব সময় একটি ছড়ি থাকত। সে ছড়ি দিয়ে নবাব বড়লাটের টেবিলে আঘাত করেন। এ নিয়ে চরম বাদানুবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে বড়লাটের ইঙ্গিতে তার দেহরক্ষী নবাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে এবং তিনি গুরুতর আহত হন। পরে ১৯১৫ সালের ১৬ই জানুয়ারী তার ঘটনাবহুল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।
ঐ দিন বিকেলই ৪টায় কলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন ওয়েলসলি স্কোয়ার পার্কে নামাজে জানাজা শেষে ১৭ই জানুয়ারী নবাব সলিমুল্লাহর মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। নিশ্ছিদ্র প্রহরায় নবাবের মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। তার আত্মীয়স্বজনকেও মরদেহ দেখতে দেওয়া হয়নি। ১৯১৫ সালের ১৭ই জানুয়ারী সামরিক প্রহরায় বেগম বাজারে তাকে দাফন করা হয়। (সরকার শাহাবুদ্দিন আহমদ: আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল; প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২১)। নি:সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ববাংলার মানুষের জন্য তিনি অগ্রগন্য ভুমিকা পালন করেন। কিন্তু এই ইতিহাস সমূহ আমাদের কাছ থেকে লুকায়িত।
আজ ১৬ই জানুয়ারী তাঁর মৃতু্য দিবসে আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
