টাকার বিপরীতে ডলারের দাম কোথায় যাবে


টাকার বিপরীতে ডলারের দাম কোথায় যাবে

২০১৭-১৮ সালে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কিছুটা হাস্যোচ্ছলে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘আপনারা যাঁরা বারংবার ডলারের মূল্য বাজারভিত্তিক তথা টাকার অবমূল্যায়নের কথা বলেন, তাঁরা ভুলবেন না, বাংলাদেশ একটি আমদানিনির্ভর দেশ। টাকায় আমদানি মূল্য বেড়ে গেলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ক্রয়ে সাধারণ মানুষের দুর্গতি বাড়ে। আমিও প্রত্যুত্তরে হেসে একটি বিকাশমান অর্থনীতিতে সঠিক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির দিকে তাঁর নজর আকর্ষণ করেছিলাম।

অনেক দিনের ব্যাংকিংয়ে সম্পৃক্ততা আর দেশি-বিদেশি বৃহৎ আমদানিকারকদের সঙ্গে বেড়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়, ডলার টাকার বিপরীতে কোথায় যাবে? বিশেষ করে বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আগামী দিনের পরিকল্পনায় মুদ্রা বিনিময় হারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব ও দেশীয় বিভিন্ন সংকটের কারণে ২০২৩ সালজুড়েই দেশের বাজারে ডলারের প্রকট সংকট ছিল। চড়া দাম দিয়েও ডলার পাওয়া যাচ্ছিল না।

এতে গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মানে রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে। তবে ডলারের দামের হেরফেরের কারণে বিভিন্ন হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে বিভিন্ন হারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত এক বছরের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ব্যাংকগুলোয় ডলারের দামের হিসাবে অবমূল্যায়ন হয়েছে ২২ শতাংশ। খোলাবাজারে ডলারের দামে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৯ শতাংশ। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ওই হারে কমলেও চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ডলার মিলছে না।

অন্যদিকে ২০২২ সালে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছিল ২১ দশমিক ২১ শতাংশ। ওই বছরের শুরুতে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। বছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৪ টাকা। আলোচ্য সময়ে এর দাম বেড়েছে ১৮ টাকা ২০ পয়সা। ওই সময়ে ডলারের দাম বেশির ভাগ সময়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু গত বছরের শেষ দিকে বেশির ভাগ সময়ই ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যা বছর শেষেও চলমান ছিল। দুই বছর ধরেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি কমেছে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলে বৈশ্বিক সংকটের শুরু। তখন এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়তে শুরু করে। এ হিসাবে গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে হয়েছে ২৮ দশমিক ২১ শতাংশ। কিন্তু ব্যাংকগুলোয় ডলার বেচাকেনার গড় হিসাবে অবমূল্যায়ন হয়েছে ৪৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। সন্দেহ নেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার কারণে অর্থনীতিতে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বৈদেশিক দায়দেনার পরিমাণ বেড়ে গেছে, আমদানি খরচ বেড়েছে। এর প্রভাবে বেড়েছে আমদানি পণ্যের দাম। আমদানি পণ্যের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে অন্যান্য পণ্যের ওপরও।

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সব ধরনের পণ্যের পরিবহন খরচও বেড়েছে। এতে খাদ্যপণ্যসহ সব পণ্যের দাম বেড়েছে। চলতি বছরের শেষ দিকে এসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বিবিএসের হিসাবে ১২ শতাংশ অতিক্রম করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাবে দেশের আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। ওই বছরের এপ্রিল থেকেই ডলারের দামে প্রভাব পড়তে থাকে। ফলে এপ্রিল থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, যা এখন আরও বাড়ানো হয়েছে।

বর্তমানে বাণিজ্যিক পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে আগাম ডলারের সংস্থান ছাড়া ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে না। এতে এসব পণ্যের আমদানি কমে গেছে। একই সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আমদানিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান দিচ্ছে। এভাবে অত্যাবশ্যকীয় আমদানি স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। তবে বাণিজ্যিক আমদানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঝেমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর হয়েছে। কিন্তু এতে বাজারে ডলারের দাম কমলেও প্রবাসী আয় প্রবাহ কমে গেছে। একই সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বাজারে আরও অস্থিরতা বেড়েছে। ফলে বছরের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেকটা শিথিল করেছে।

এই শিথিলতার সুযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে থাকে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোয় রেমিট্যান্স কেনার সর্বোচ্চ দর হচ্ছে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা। তদুপরি সরকারের আড়াই শতাংশ ও ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ প্রণোদনাসহ মোট ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারে। এ হিসাবে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম হওয়ার কথা ১১৪ টাকা ৩০ পয়সা। কিন্তু প্রায় সব ব্যাংকই ১২২ থেকে ১২৬ টাকা করে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে। এর কমে বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো রেমিট্যান্সের ডলার বিক্রি করছে না। ফলে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে।

এসব ডলার গ্রাহকদের কাছে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা করে বিক্রি করার কথা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কেনা ডলার ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উদ্যোগে সংগ্রহ করা কোনো ডলার ওই দামে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বেশির ভাগ সময় আমদানিতে ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৪ থেকে ১২৮ টাকা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি দামে ডলার কেনার নজিরও রয়েছে। পত্রিকান্তরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলেছেন, বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো দেশে ডলার–সংকটের কথা জানে। এ কারণে তারা ডলারের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখন বাড়তি দামে না কিনলে তারা ডলার দিচ্ছে না। ফলে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়ে ডলার-সংকট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, গত বছরের শুরুর দিকে প্রতি ডলারের দাম ছিল ১০৪ টাকা। এখন তা বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে। এ হিসাবে টাকার মান কমেছে ৬ টাকা বা ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। কিন্তু বাজারে এই দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রতি ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৪ থেকে ১২৬ টাকায়। কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি দামে ডলার কিনছে। গড়ে প্রতি ডলার ১২৬ টাকায় বিক্রি হলেও এক বছরে এর দাম বেড়েছে ২২ টাকা। এ হিসাবে টাকার মান কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। গত বছরের শুরুতে খোলাবাজারে ডলারের দাম ছিল ১০৬ টাকা। বছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৭ টাকায়। এ হিসাবে টাকার মান কমেছে ২১ টাকা বা ১৯ শতাংশ। গত আগস্টে এর দাম বেড়ে ১৩০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপে ডলারের দাম খোলাবাজারে কিছুটা কমেছে।

২০২৪ সালে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম কত হবে, সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা চলুন একটু দোয়া করে নিই, যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাজার অপারেটররা তাদের অপরিকল্পিত ও মাথাগরম সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে প্যানিক বা আতঙ্ক সৃষ্টি না করে কিংবা কম্বোডিয়ার মতো একটি ‘ডলারাইজড ইকোনমি’ তৈরিতে আমাদের উৎসাহিত না করে। আমরা যদি রপ্তানি আয়ের আকাঙ্ক্ষিত প্রত্যাবাসন ও প্রবাসী আয় আরও বেশি ব্যাংকিং বা অফিশিয়াল চ্যানেলে আনতে চাই, তাহলে বাজারকে বাজারের মতো চলতে দিতে হবে। এতে হয়তো একটু সাময়িক ঝাঁকুনি হতে পারে, কিন্তু ধীরে ধীরে বাজার তার জায়গায় চলে যাবে। যেকোনো বিকাশমান অর্থনীতির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বাজারে দেশি, বিশেষ করে বিদেশি মুদ্রার তারল্য বাড়ানো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হবে রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড় নয়, বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করা এবং সেই লক্ষ্যে নির্দিষ্ট উন্নয়ন-সহযোগী ও অংশীজনদের সঙ্গে একযোগে কাজ করা। সে ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কা আমাদের কাছে উদাহরণ হতে পারে।

● মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *