আল-বেরুনী: একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মুসলিম জ্যোতির্বিদ


এম,এ হক

ইরানের একটি স্থানের নাম বেরুন। সেখানে জন্ম হয় আবু রায়হানের। সেটা ছিল ৯৭৩ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর। তাঁর আসল নাম ছিল আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বেরুনী। ইতিহাসের তিনি বেরুনী নামে সবচেয়ে বেশী পরিচিত।

আল বেরুনী ‘কানুনে মাসউদী’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটি তাঁর সেরা বই। সুবিশাল এই গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে, তৃতীয় খন্ডে ত্রিকোনমিতি, চতুর্থখন্ডে আকৃতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান, পঞ্চম খন্ডে গ্রহ, দ্রাঘিমা, চন্দ্রসূর্যের মাপ, ষষ্ঠ খন্ডে সূর্যের গতি, সপ্তম খন্ডে চন্দ্রের গতি, অষ্টম খন্ডে চন্দ্রের দৃশ্যমা ও গ্রহণ, নবম খন্ডে স্থির নক্ষত্র, দশমখন্ডে ৫টি গ্রহ নিয়ে এবং একাদশ খন্ডে জ্যো‌তিষ বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা হয়ে‌ছে।

কোপার্নিকাস বলেছি‌লেন, পৃথিবী সহ অন‌্যান‌্য গ্রহগুলো সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে। অথচ কোপার্নিকাসের জন্মের ৪২৫ বছর আগে আল বেরুনী বলে গেছেন, পৃথিবী বৃত্তিক গতিতে ঘোরে। তিনি টলেমি ও ইয়াকুবের দশমিক অংকের গননায় ভুল ধরে তার সঠিক সমাধান দেন। তিনিই সর্বপ্রথম অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেন। তিনিই প্রথম প্রাকৃতিক ঝর্ণাও আর্টেজিয় কূপের রহস্য উদঘাটন করেন। তিনি একজন খ্যাতনামা জ্যোতিষী ছিলেন। তিনি যেসব ভবিষ্যদ্বানী করতেন সেগুলো সঠিক হত। তিনি শব্দের গতির সাথে আলোর গতির পার্থক্য নির্ণয় করেন। তিনি এরিষ্টটলের ‘হেভেন’ গ্রন্থের ১০টি ভুল বের করেন। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্কটিও তিনি আবিষ্কার করেন। তিনি আরবী, ফার্সী, সিরীয়, গ্রীক, সংস্কৃতি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। তি‌নি ত্রিকোনোমিতির বহু তথ‌্যও আবিষ্কার করেন।

১০৩০ সালে আল-বেরুনী পৃথিবীর পরিধি পরিমাপের জন্য ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করেছিলেন। তার অনুমান ছিল পৃথিবীর পরিধি ৬৩৩৯.৬ কিলোমিটার, বর্তমা‌নে যা ৬৩৭৮.১ কিলোমিটার। তিনি পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করেছিলেন ৯৯.৭% নির্ভুলতার সাথে।

১৭ শতক পর্যন্ত ফরাসী গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিন পিকার্ড পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করার আরও সু‌নি‌র্দিষ্ট পদ্ধ‌তি আবিষ্কার করার আগ পর্যন্ত আল-বেরুনীর পৃথিবীর পরিধির পরিমাপের পদ্ধ‌তি‌টিই ছিল সবচেয়ে নির্ভুল।

আল বেরুনী সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এক মহাপন্ডিত। তাঁর ও অন্যান্য মুসলিম বিজ্ঞানীদের মৌলিক আবিষ্কারের উপ‌রেই গড়ে উঠে‌ছে আজকের আধুনিক বিজ্ঞান। তাদের অবদানকে অস্বীকার করা অকৃতজ্ঞতার পরিচয়।

তিনি ৬৩ বছর বয়সে কঠিন অসুখে পড়েন। বহু চিকিৎসার পরেও তিনি আর সুস্থ হতে পারেননি। অবশেষে ৭৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। এটি ছিল ১০৪৮ খৃষ্টাব্দের ১৩ই ডিসেম্বর রোজ শুক্রবার।

প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক জর্জ সার্টন বলেছেন, আল বেরুনী সকল যুগের ও সকল দেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী‌দের অন্যতম। সভ্যতার ইতিহাসে তাঁর যে বিরাট অবদান রয়েছে তা কোনদিন মুছে যাবার নয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *