বিক্ষোভে গুলি চালানো কি ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদের ‘অধিকার’


পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ ঠেকাতে মাঠে নামেন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুবলীগ নেতা আওলাদ হোসেন। তাঁকে গুলি ছুড়তেও দেখেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
মঙ্গলবার ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকায়।

পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ ঠেকাতে মাঠে নামেন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যুবলীগ নেতা আওলাদ হোসেন। তাঁকে গুলি ছুড়তেও দেখেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। মঙ্গলবার ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকায়।ছবি: প্রথম আলো

যেসব দেশের সঙ্গে গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানিতে আমাদের প্রতিযোগিতা হয়, কখনো তাদের পেছনে ফেলে আমরা ১ নম্বরেও চলে যাই; সেসব দেশের তুলনায় এ দেশের পোশাকশ্রমিকদের বেতন-মজুরির তফাৎ দেখলে অবাকই করে।

দেশের পোশাকশিল্প বিকাশের অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়, এখানকার সস্তা শ্রম। কিন্তু সেই সস্তা শ্রম যে এতটাই সস্তা, তা বোধ হয় শিক্ষিত নাগরিক সমাজ জানেই না। সস্তা শ্রমের মতো এসব শ্রমিকের জীবন যে আরও বেশি সস্তা, সেটিও আমরা দেখি মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভে গুলি চালানোর ঘটনায়।

কিছুদিন ধরে ঢাকাসহ এর আশপাশে শ্রমিক অঞ্চলগুলোতে গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ-আন্দোলন করছেন। পোশাক খাতের সর্বনিম্ন মজুরি আট হাজার টাকা। সেই টাকায় একজন শ্রমিকের পরিবার কী করে চলে?

দফায় দফায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কয়েক মাস আগে পর্যন্ত সম্বল ছিল ডিম আর আলু। সেই ডিম আর আলু কিনতেই এখন নাভিশ্বাস। কয়েক সদস্যের একটি পরিবার চালাতে কয়েক ঘণ্টা ওভারটাইম করতে বাধ্য হন তাঁরা। এতে আরও কিছু টাকা মিললেও তা দিয়ে এ দুর্দিনে কীভাবে চলা সম্ভব?

বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ২৩-২৫ হাজার টাকা মজুরি দাবি ও নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠনে আশাবাদী হয়েছিলেন পোশাকশ্রমিকেরা। কিন্তু মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরি প্রস্তাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তাঁরা। কারণ, ওভারটাইম করে মোট যে টাকা মাসে পান তাঁরা, সেই তুলনায়ও কম প্রস্তাবিত এ মজুরি।

স্বাভাবিকভাবেই প্রস্তাবিত এ মজুরিকে মানতে পারেন না শ্রমিকেরা। দাবি আদায়ে কঠোর আন্দোলনে নামেন তাঁরা। সেই আন্দোলন ঠেকাতে মাঠে নামে পুলিশ ও মালিকপক্ষের লোকেরাও। ফলে সেখানে সংঘর্ষ-ভাঙচুর অনিবার্য। সোমবার পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় গাজীপুরে আহত এক শ্রমিক হাসপাতালে মারা গেছেন। একই দিন কোনাবাড়ী এলাকায় কারখানায় দেওয়া আগুনে মারা গেছেন আরেক শ্রমিক।

পরদিন মঙ্গলবারও এসব এলাকায় দেশে শ্রমিক বিক্ষোভ হয়। সংঘর্ষও হয়। মিরপুরের পল্লবী এলাকায় বিক্ষোভরত পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ ঠেকাতে স্থানীয় প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তির লোকজন আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামেন। সেখানে ছিলেন সরকারদলীয় নেতাও। তাঁদের মধ্যে আওলাদ হোসেন ওরফে লাক্কু নামের যুবলীগের এক নেতার ছবি মঙ্গলবার প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর আশপাশে কয়েকজন লাঠি হাতে আর তিনি লম্বা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে। এতটাই তিনি বেপরোয়া যে নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য কোনো মাস্ক বা মুখোশ, এমনকি মাথায় হেলমেটও পরেননি।

আওলাদ মিরপুর অঞ্চলের বিভিন্ন পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে আছেন। তিনি সন্ত্রাসী ও ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করেন, এমনটাই বক্তব্য একই কমিটি সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনের।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আওলাদ হোসেন আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলিও ছুড়েছেন। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আওলাদের এ ছবির সবগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে নিয়ে খোঁজ করারই সময় পায়নি। বুধবার প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদনে পল্লবী থানার পুলিশ এমন বক্তব্য দিয়েছে।

চকরিয়া পৌর শহরে সংঘর্ষে অস্ত্র হাতে ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি বেলাল উদ্দিন (লাল হেলমেট পরা)। পেছনে লাঠিসোঁটা হাতে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। ১৬ আগস্ট, ,২০২৩

চকরিয়া পৌর শহরে সংঘর্ষে অস্ত্র হাতে ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি বেলাল উদ্দিন (লাল হেলমেট পরা)। পেছনে লাঠিসোঁটা হাতে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। ১৬ আগস্ট, ,২০২৩ছবি: সংগৃহীত

যেকোনো বিক্ষোভই সরকারের জন্য অস্বস্তিকর। যদি সেই সরকারের ক্ষমতায় বসা ও টিকে থাকা হয় প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে, সেই অস্বস্তি আরও বেশি হওয়ারও কথা। ফলে কী কারণে বিক্ষোভ, দাবিদাওয়া কী—সেসবের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে সেই বিক্ষোভকে দমন করা।

বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকারি বাহিনী হিসেবে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তো আছেই, পাশাপাশি সরকারদলীয় নেতা–কর্মীদেরও আমরা দেখে থাকি। যেকোনো রাজনৈতিক সংঘর্ষে সরকারি বাহিনীর আশপাশে অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা–কর্মীদের দৃশ্যও নতুন নয়। কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের দমনে তাঁদের মাঠে নামানো হয়েছিল। বারবার হেলমেট পরে হামলার জন্য হেলমেটলীগ হিসেবেও তাঁরা এখন পরিচিত হয়ে উঠেছেন।

গত কয়েক মাসে প্রথম আলোয় কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা ছাড়াও সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়।

গত সেপ্টেম্বরে মাগুরায় স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের সময় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে এক যুবকের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সংঘর্ষে গুলির শব্দও শোনেন স্থানীয় লোকজন। বিএনপি নেতাদের দাবি, ওই যুবক স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা।

গত আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজা ঘিরে কক্সবাজারের চকরিয়ার পৌর শহরে এক সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা যায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা–কর্মীদের। মিছিলের সামনে থেকে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা যায় স্থানীয় এক ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতিকে। সংঘর্ষের সময় অস্ত্রধারীর সঙ্গে মিছিলে ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলমও। অস্ত্রধারীরা তাঁর সামনে-পেছনেই ছিলেন। সেই সংঘর্ষে জামায়াতের একজন নিহত হন।

গত মে মাসে পিস্তল হাতে মিছিল করেছেন চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে আয়োজিত মিছিলে তাঁকে পিস্তল হাতে দেখা যায়। বৈধ অস্ত্রও যদি হয়ে থাকে, সেই অস্ত্র নিয়ে এভাবে একজন সংসদ সদস্যের প্রকাশ্যে মিছিল সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।

গত বছরের মে মাসে ছাত্রদল নেতা–কর্মীরা মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের হামলার মুখে পড়ে। দুই দলের মধ্যে সেদিন বড় সংঘর্ষ হয়। ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা আদালত প্রাঙ্গণে ঢুকেও রেহাই পাননি। সেখানে তাঁদের চরমভাবে পেটান ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। সেদিন সংঘর্ষে গুলির শব্দও শোনা যায়। এক ছাত্রলীগ নেতাকে দেখা যায়, আগ্নেয়াস্ত্র হাতে। হকিস্টিক, রামদা, রড, লাঠি তো ছিলই, তাদের হাতে।

গত জুলাই মাসে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের এক সভা শেষে সাংবাদিকদের কাছে এক বক্তব্যে অভিযোগ করেন, বিএনপি আগ্নেয়াস্ত্র এনে মজুত করছে। তিনি বলেন, ‘সীমান্তের এপার থেকে খবর পাচ্ছি, অস্ত্র কিনছে তারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ তাদের অস্ত্র সরবরাহের একটি ঘাঁটি। আগ্নেয়াস্ত্র এনে তারা মজুত করছে।’ তাঁর মতে, বিএনপি ভোটে জিততে পারবে না বুঝে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইছে। (২৫ জুলাই, যুগান্তর)

অথচ আমরা দেখি, যশোরের এক ছাত্রলীগ নেতা ভারত থেকে আনা অস্ত্র বিক্রির একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। রাজধানী ঢাকা, সীমান্তবর্তী যশোর, সাতক্ষীরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সক্রিয় রয়েছেন এই চক্রের অর্ধশতাধিক সদস্য। গত ছয় বছরে ২০০টির বেশি অস্ত্র বিক্রি করেছেন সেই ছাত্রলীগ নেতা ও তাঁর সহযোগীরা। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সেই ছাত্রলীগ নেতা আকুল হোসেনকে কয়েকজন সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছিল ডিবি পুলিশ। (৩ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো)

এখন আকুল হোসেন নিশ্চয়ই একজন না, আরও আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আকুল হোসেনদের বিক্রি করা সেসব অস্ত্র কোথায়? এসব অস্ত্র কারা মজুত করেছেন? বিএনপি অস্ত্র মজুত করছে—এমন অভিযোগের সত্যতা কতটুকু? গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে কোনো বিএনপি নেতা–কর্মীর ছবি সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, এমনটি আমার চোখে পড়েনি। সংঘর্ষের একটি ঘটনাস্থলে থেকেও দেখেছি, সেদিন বিক্ষুব্ধ বিএনপি নেতা–কর্মীদের হাতে লাঠিসোঁটা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না।

কথা হচ্ছে, বিক্ষোভ দমন বা সংঘর্ষ ঠেকাতে এখন সরকারি বাহিনীই যথেষ্ট নয়। সেখানে অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা–কর্মীদেরও লাগে। বৈধ-অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহন করলে, গুলি ছুড়লে, এমনি মানুষ মারলেও তাদের যে কিছু হবে না, সেটির নিশ্চয়তাই যেন আমরা বারবার দেখি। এ যেন তাঁদের অধিকার! এখন এই অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে, সেই প্রশ্ন পাঠক তুলতেই পারেন।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *