‘জায়নবাদ’ এর সুপরিকল্পিত কূট‌কৌশল


এম, এ হক

এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন দন্দ্ব হচ্ছে ধর্মীয় দন্দ্ব। যেই দন্দ্বের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইসরাইল প্যালেস্টাইন ইস্যু মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে পুরোনো বিরাজমান দ্বন্দ যেটা সমাধানে কেউই কোনো কিছু করতে পারে নি।

১৮ এবং ১৯ শতকে ইহুদীদের মধ্যে “হাসকালা” আন্দোলন না‌মে একটি আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিলো পশ্চিমা ধর্মীয় নিরপেক্ষ শিক্ষা এবং সংস্কৃতির সাথে হিব্রু ধর্মীয় শিক্ষার একটা বন্ধন তৈরী করা। এই আন্দোলনের কেন্দ্র ছিলো বার্লিন। তৎকালীন সম‌য়ে ইহুদীরা বেশীরভাগই ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিচরণ করত। সেই সময়েই তারা মনে করে যে তাদের একসাথে থাকা উচিৎ, নিজেদের জন‌্য একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করা উচিত। সেই ধরাণারই একটি রাজনৈতিক ধারণা দেন অস্ট্রিয়ান সাংবা‌দিক থিওডর হার্টজেল। বলা বাহুল‌্য সেও ছিল একজন ইহুদী।

তিনি এন্টি সে‌মি‌টিজম তথা ইহুদীদের উপর বৈষ্যমের কথা তুলে ধরে ইহুদী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালে বাসেল, সুইজারল্যান্ড প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তারা বলেন- “জায়োনিজম এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহুদীদের জন্য প্যালেস্টাইনে একটা নিরাপদ আবাস নির্মাণ করা যেটি আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে।” 

এভাবে প্রতি দুই বছর অন্তর জায়োনিস্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়া শুরু করে। তারা প্যালেস্টাইনের স্বায়ত্তশাসন দাবী করলে সেটা অটোমানরা নাকচ করে দেয়। এরপর তারা ব্রিটিশদের কাছে যায়, ব্রিটিশরা সেটেলমেন্টের জন্য বর্তমান আফ্রিকার উগান্ডাকে প্রস্তাব করে কিন্তু তারা প্যালেস্টাইনের জন্যই গো ধরে বসে থাকে।

১৯০৫ সালে রাশিয়ার বিপ্লবের পর অনেক ইহুদী দেশ ছেড়ে প্যালেস্টাইনে চলে আসে। এরপর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ১৯১৭ সালে জায়োনিস্ট আন্দোলন রাশিয়ান ইহুদী‌দের হাতে চলে যায়। ইংল্যান্ডে অবস্থিত দুই জায়োনিস্ট নেতা চেইম ওয়াইজম্যান এবং ন্যাহুম সকোলোর উদ্যোগে ব্রিটেন বেলফোর ঘোষণার মাধ‌্যমে তারা প্যালেস্টাইনে ইহুদীদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ব‌্যক্ত দেয়। সেটি পরে ১৯২২ সালে জাতিসংঘের ম্যাণ্ডেটে অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর প্যালেস্টাইনে ইহুদী স্যাটলারদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। মার্চ ১৯২৫ সালে প্যালেস্টাইনে ইহুদীর সংখ্যা ছিলো ১০ লাখ, সেটি ১৯৩৩ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ২৩ লাখে।

এরপরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি, হিটলারের উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হলোকাস্টে ইহুদীদের উপর চালানো ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদীরা দলে দলে প্যালেস্টাইনে এসে আবাস গড়ে। তবে জায়নবাদীরা সেটুকুতে সন্তুষ্ট হ‌তে পারে‌নি। প্রচন্ড বুদ্ধিমান এই জাতি খুব দ্রুতই নিজেদের গুছিয়ে শক্তিশালী ক‌রে প্যালেস্টাইনের অধিবাসীদের উপর দখলদারী আচরণ শুরু করে। এরপর “ছয়দিনের যুদ্ধে” তারা জানান দেয় যে তারা নিজেরাই এখন শাসন করবে।

থিওডোর হার্টজেল কোন ধর্মপ্রাণ লোক না, নেতা‌নিয়াহু, বেন গুরিয়ন বা এরিয়েল শ্যারন তারা কেউই রেবাই ছিল না। আইএসআইএস-এর মতোই তারা তাদের ইহুদীবাদের ধর্মনিরপেক্ষ তত্ত্ব‌কে সম্পূর্ণরূ‌পে ধামাচাপা দি‌য়ে, বিভ্রান্তি তৈরীর মাধ‌্যমে একটি যৌক্তিক  অবকাঠা‌মো দাঁড় করানোর জন‌্য ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে যা খুশী তা কাট এবং পেস্ট করছে। তারা শুধুমাত্র ইস্রায়েলে ধর্মীয় ইহুদীদের সহ্য করে কারণ তারাই কেবল সন্তান জন্ম দেয়। আর ইহুদীবাদের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকল্প সবসময় জনসংখ্যা সমস্যায় জর্জরিত। নাস্তিকরা খুব বেশী সন্তান জন্ম দেয় না আর জায়নবাদীরা বেশিরভাগই নাস্তিক। হতে পারে অর্ধেক ইসরায়েলি ধর্মনিরপেক্ষ আর তাছাড়া অর্ধেকেরও বেশী ধারণা ক‌রে ইহুদী হতে হ‌লে ঈশ্বরে বিশ্বাস করাটা জরুরী নয় এবং প্রায় এক চতুর্থাংশই ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। এ কারণেই ধর্মীয় ইহুদীরা জায়োনিস্টদেরকে ইহুদী বলেও মনে করে না। কারণ তারা বিপথগামী, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ক্ষমতা লিপ্সু। তারা ক্ষমতা পেলেই দুর্নীতি আর অনৈতিক কর্মকা‌ন্ডে জ‌ড়িয়ে প‌ড়ে।

এর সব‌কিছুই র‌য়ে‌ছে জগৎ বিখ্যাত ফোর্ড কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা হেনরী ফো‌র্ডের সাড়া জাগা‌নো বই “সি‌ক্রেটস অব জায়োনিজম” বইটি‌তে। ইহুদী জাতির ইতিহাস এই বইয়ের মূল আলোচ্য বিষয়। তারা কেমন ক্ষমতাবান জাতি ছিল তারপর কিভাবে ধ্বংস হল, কখন যাযাবরের মত জীবন কাটিয়েছে আর বর্তমানে কেমন করে এই পর্যায়ে পৌঁছেছে তার বিস্তর বিবরন দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ‌্য হেনরী ফোর্ড নিজেও তাদের শিকারে পরিনত হয়েছিলেন।

বইটিতে দেখানো হয়েছে ইহুদী জাতির একটা অদৃশ্য রাষ্ট্র ছিল যে রাষ্ট্রের কোন সীমানা বা আয়তন ছিল না। ইহুদীরা খুব চৌকশ এবং কূটকৌশলী হবার কারণে তারা বিভিন্ন দেশের উচ্চপদস্থ সরকারী কাজে ঠাঁই পেত। সেইরকম সব ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হ‌য়েছিল রাষ্ট্রটি যার নাম ছিল “সিনহাড্রিন”।

এই রাষ্ট্রের সংসদে তারা জান্টাইলদের কিভাবে পশু বানিয়ে পুরো পৃথিবী শাসন করবে তারই একটা নীল নকশা বানিয়েছিল। সেখা‌নে বেশ কিছু প্রটোকল ছিল যা দিয়ে জান্টাইলদের কিভাবে পশু বানানো যায় তার। দুর্ভাগ্যবশত তাদের সেই পরিকল্পনাগুলো ফাঁস হয়ে গেলে সেগুলো তারা অস্বীকার করে।

কিন্তু অবাক লা‌গে যে আজকের এই পৃথিবী তাদের বানানো সেই প্রটোকলেই চল‌ছে। এক চুলও পার্থক্য পাওয়া যা‌বে না।

আস‌লে “জায়োনিজম” একটি চরমপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শ যা ধর্ম এবং ধর্মীয় পরিচয়কে মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করছে।

অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের চারদিকে মুসলিম দেশগুলোর মাঝে একটি ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া, মুসলমানদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, মুস‌লিম‌দের ঐক্যে কতবড় ফাটল রয়েছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *