আমরা কি ধর্মভীরু না‌কি ধর্মান্ধ?


এম,এ হক

নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসানোর উদ্দেশ্যে অন্যের ধর্মকে নিজের ধর্মের সাথে তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ইচ্ছে এবং তদ্বজনিত কারণে অন্যের ধর্মকে তাচ্ছিল্য করাই ধর্মান্ধতা।

ঔপনিবেশিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের কারণে এই ধর্ম সন্ত্রাসের বীজ অনেক আগেই বাংলার মাটিতে বপন করা ছিল যা এখন বড় মহীরুহে পরিণত হয়েছে।

দেলোয়ার হোসেন সাইদী সাহেব মারা যাওয়া (৮.৪০) আর কাকতালীয়ভাবে একই রাতে ভিন্ন সময়ে এই ভূমিকম্প (৮.৫০) হওয়ায় দেখলাম অনেকেই এই ভূমিকম্পকে সাইদী সাহেবের দুনিয়া ত্যাগকালীন সময়ের নিদর্শন বলে আখ্যা দিচ্ছেন। এটি তাদের নিজেদের দূর্বল ঈমান ও অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না।
রাসূল (সাঃ) এর পুত্র ইবরাহীম এর মৃত্যুর দিনে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। তখন সাহাবীগণ বলাবলি করছিল নবীপুত্রের মৃত্যুর কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়েছে। এসব কথা শুনে রাসূল পাক (সঃ) বলেনঃ “সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহ তায়ালার অগণিত নিদর্শনের দুটি। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ হয় না।” (সহীহ বুখারী: ১০৪৩)
কারো জন্ম বা মৃত্যুতে যেমন সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণ হয় না, তেমনি ভূমিকম্প ও হয় না। এটিও আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে আসা নিদর্শন।

ধর্মবিশ্বাস হল কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি যুক্তিহীন অলীক বিশ্বাস। এই বিশ্বাস ছোট বেলা থেকেই গড়ে ওঠে পরিবারকে কেন্দ্র করে। শিশু যে পরিবারে বড় হয়ে ওঠে সেই পরিবারের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসই শিশুটির ধর্মবিশ্বাস হিসাবে পরিগণিত হয়।

সে যতই বড় হতে থাকে বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পরিবর্তে বাঁধনের বজ্র আটু‌নি‌তে পথভ্রষ্ট হয়। আস্তে আস্তে ভালো লাগতে শুরু করে এই বন্ধন। ভালোলাগা থেকে জন্মায় ভালবাসা। অন্ধ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা এতটাই অন্ধ হতে শুরু করে যে, সে প্রশ্ন করতে ভুলে যায়, সত্য-মিথ্যার কষ্টি পাথরে কোনো ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করতে ভুলে যায় সে। বিনা প্রশ্নে অনুসরণ আর অনুকরণ করতে ভাল লাগে তার। নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস হিমালয়ের গগনচুম্বী শিখরের মত অটুট থাকে আর অন্য সব মত বিশ্বাস হয়ে যায় মিথ্যা। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় ধর্মান্ধতা।

ইসলামে আন্দাজ অনুমানে কথা বলা হারাম।
মহান আল্লাহ্ পাক বলেন, “ধ্বংস হোক তারা, যারা আন্দাজে কথা বলে”
(সূরা যারিয়াত: ১০)

ধার্মিক নিজে ধর্মীয় অনুশাসন মানে ও অন্যকে মানতে উৎসাহ দেয়। ধর্মান্ধ নিজে মানে না। কিন্তু অন্যকে দোষারোপ করতে পিছপা হয় না।

ধার্মিক স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ধর্মের রীতিনীতিকে প্রয়োগ করার বিষয়টি বোঝে। ধর্মান্ধ স্থান-কাল-পাত্র বোঝে না।

ধার্মিক আল্লাহর নির্দেশকে পালন করে। ধর্মান্ধ কখনও কখনও অতি আবেগে আল্লাহ এবং নবীদের দেখানো পথকে ভুলে যায়। নবীর হাদিস দেখেও দেখে না।

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা ধারণা- অনুমান থেকে বেঁচে থাক, কারণ ধারণা- অনুমান সর্বাপেক্ষা মিথ্যা কথা”।
(বুখারী হা/৬০৬৬,৬৭২৪; মুসলিম হা/৬৪৩০)

বিবেকবান,অসাম্প্রদায়িক, মুক্তবুদ্ধি, যুক্তিবাদী মনের মানুষ যেন আর তৈরী হতে না পারে তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে ছলে -বলে কৌশলে।

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে পড়ুয়া ছে‌লে-‌মে‌য়েরা বাংলাদেশে বসে পাশ্চাত্যের অদেখা সংস্কৃতি আর ইতিহাস পড়ে তাদের চারপাশের বাংলা সংস্কৃতির মধ্যে যোগসূত্র তৈরী করতে পারছে না। মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্রটিরও একি সমস্যা। ইসলামের যে ইতিহাস সে জানছে, অদেখা আরবের সংস্কৃতি সে যা পড়ছে তার সাথে তার নিজস্ব যাপিত জীবনের বা বাংলাদেশের ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নেই।

ভিন দেশের ভাষায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম অর্থ না বুঝে ধর্ম গ্রন্থ পড়লে যা হবার তাই হচ্ছে আজকের বাংলাদেশে। ধর্ম গ্রন্থগুলোকে বুঝে পড়তে হবে। ভয়, ঘৃণা, বিদ্বেষের এক চোখা নী‌তি দিয়ে ধর্ম গ্রন্থ পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

ধার্মিক আর ধর্মান্ধের এই পার্থক্য বুঝতে আলেম হওয়া লাগে না। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো সম্বন্ধে যারা ওয়াকিবহাল তারাও এসব বুঝতে পারবে যদি তারা তা‌দের উর্বর ম‌স্তিস্কটা‌কে একটু খাটায়।

ধর্মের সার কথাটি অনুভব করার অক্ষমতাই জন্ম দেয় ধর্মান্ধতার।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *