মদিনা সনদ-বিসমিল্লাহ-রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে ইনু-মেননের চুলকানি


এটা সিয়াম সাধনার রমজান মাস। সারাবিশ্বের মুসলমানদের যাপিত-জীবন সুচিতে পরিবর্তন এসেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের মননে এখন রোজা-তারাবি-সাহরি-ইফতার। পরিবর্তন হয়নি শুধু ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি ও জাসদের হাসানুল হক ইনু এমপির মনন। ‘রাতের নির্বাচনে’ নৌকায় চড়ে এমপি হয়ে পবিত্র রমজান মাসে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে বিয়োদগার করেছেন। ‘বিসমিল্লাহ হির রাহমানির রাহিম’ শব্দ দিয়ে কেন সংবিধান শুরু করা হয়েছে তা নিয়ে তাদের চুলকানি। এমনকি হাসানুল হক ইনু প্রশ্ন তুলে বলেছেন, মদিনা সনদে বিসমিল্লাহ নেই অথচ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ চাপিয়ে দিয়েছে।

নৌকায় চড়ে এমপি হওয়ায় সংসদের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তোয়াজে কমতি ছিল না দুই নেতার বক্তব্যে। ‘তিনিই’ যেন তাদের ত্রাতা। দুই নেতার মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের অনেক কিছু পরিবর্তন করলেও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ এবং ‘বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম’ রেখে মহাঅন্যায় করেছে। সংবিধানের চার মূলনীতির সঙ্গে বেঈমানি করেছে। পবিত্র রমজান মাসে জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর আনা সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে গতকাল দুই নেতা সংবিধানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং বিসমিল্লাহ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা সংবিধান থেকে এই শব্দগুলো তুলে দেয়ারও পরামর্শ দেন। তবে সংসদে উপস্থিত অন্যান্য সদস্যরা তাদের বক্তব্যে তেমন সাড়া দেননি।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সংবিধানের চার মূলনীতির সঙ্গে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম’ সাংঘর্ষিক দাবি করে সেগুলো বাদ দিতে সংবিধান পর্যালোচনায় সংসদীয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, ‘সংবিধানের চার নীতি পুনর্জীবনের পরে এই সংঘর্ষিক অবস্থা (বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম) আমাদের বিব্রত করছে। সংবিধানের এই সাংঘর্ষিক অবস্থা থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে যা যা সাংঘর্ষিক তা বিলোপ সাধন করার বিবেচনা করা। এসব আলোচনার বিষয়গুলো নিয়ে আমি সংবিধান পর্যালোচনার করার জন্য সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান করে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সংবিধান পর্যালোচনার জন্য বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করছি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৪৭ বিধিতে সংসদে উত্থাপিত সাধারণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে হাসানুল হক ইনু ‘মদিনা সনদ’ নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলার স্পর্ধা দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যে আলোচনাগুলো মাঠে আছে প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতির পাশাপাশি দলভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি, শ্রেণি পেশারক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও স্থানীয় সরকারদের নিয়ে একটি উচ্চকক্ষ গঠন করার এবং অনাস্থা বিল ও অর্থবিল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা বিল বাদ দিয়ে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে এমপিদের আইন তৈরি আরো ক্ষমতা প্রদান, সংসদের স্থায়ী কমিটিতে উন্মুক্ত করা ও সকল স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং সংবিধান ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ব্যবস্থা, খাদ্য ব্যবস্থা ও সামাজিক নিরপত্তা ব্যবস্থা এবং ইন্টারনেট সার্বজনীন ব্যবহার অধিকার সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে স্বীকৃতি দিয়ে বাস্তবায়ন করতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করা। বিচারপতিদের নিয়োগ ও অভিশংসনের বিষয়টি আবার পর্যালোচনা করা। রাষ্ট্রের কোনও লিঙ্গ, ধর্ম, জাত-পাত নেই। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ বাতিল করতে হবে। স্বয়ং মহানবী (সা.) মদিনা সনদে কোনো বিসমিল্লাহ ব্যবহার করেননি, উনি (মহানবী) কোনোদিনই ধর্মকে ব্যবহার করেননি।’

উল্লেখ গুগলে দেখা যায়, মহানবী (সা.) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। সে সময় মদিনায় বানু আউস ও বানু খাযরাজ নামের দু’টি সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করতো। তাদের মধ্যে গোষ্ঠিগত বিরোধ ছিল। মহানবী (সা.) ওই দুই সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীগত হিংসা-বিদ্বেষ নিরসন করে সুশাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ৪৭ ধারার একটি ‘সনদ’ প্রণয়ন করেন। সেটাই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান; যা ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। হাসানুল হক ইনু সেই সদনে বিসমিল্লাহ লেখা নেই তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর উত্থাপতি প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে রাশেদ খান মেনন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ও ‘বিসমিল্লাহ হির রহমানের রাহিম’কে সংবিধানের জঞ্জাল হিসেবে অবিহিত করেন। তিনি বলেন, সংবিধানে যে ধর্ম নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা রয়েছে তা লংঘন করে সেখানে সাংঘর্ষিক বিষয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে সংবিধানে যে জঞ্জাল (রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ) জমে গেছে তা দূর করতে হবে। তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে অনেক সংশোধনী হলেও সংবিধানে যে জঞ্জাল জমেছে তা এখনো দূর করা যায়নি। ১২ বিধিতে সংবিধানে যে ধর্ম নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা রয়েছে তা ভঙ্গ করে কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এখনো বহাল রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের স্বীকৃতি দিয়েছেন কিন্তু তাদের মধ্যে অসন্তোষ দূর হয়নি। তাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের চার মূল নীতিমালা ফিরিয়ে আনলেও এই জঞ্জালগুলো দূর না করলে আধুনিক স্মাট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে না। সত্যিকার অর্থে এই সংসদ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ফসল। তবে এই পার্লামেন্ট কখনো মসৃণ ছিল না। এই সংসদ কখনো আঘাত এসেছে, বাতিল হয়েছে, সংসদকে ঠুটো জগন্নাথ করা হয়েছে। ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে খন্দকার মোস্তাক খুনী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে সরকারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। অবৈধ ক্ষমতাধারী জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী করে সংবিধান পাল্টে দেন। আমরা জানি ওঝার মৃত্যু সাপে হয়, তাই হয়েছিল। তার পরে আরেক সেনা প্রধান ক্ষমতায় এসে বলেন রাষ্ট্রের সংবিধানে সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এই সংসদের আরেকটি কালো অধ্যায় জিয়াউর রহমানের আমলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি হয়। এরপরে বিএনপির ক্ষমতায় এসে জামায়াতকে নিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকরণের দিকে জোর দেন। সংবিধানের চার মূলনীতি ক্ষুন্ন হয়। দুই নেতা সংবিদানের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ও ‘বিসমিল্লাহ’ নিয়ে বিরক্ত এবং সেগুলো সংবিধান থেকে তুলে দেয়ার পক্ষে। তবে রাশেদ খান মেননের ‘ওঝার মৃত্যু সাপে হয়’ বক্তব্যে কে ওঝা আর কে সাপ তা পরিস্কার বোঝা যায়নি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *