ব্যাংকের টাকায় বিলাসী জীবন তাঁর
রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর হ্যামলেট টাওয়ারে অফিস তাঁর। পরিবার নিয়ে থাকেন আরেক অভিজাত এলাকা গুলশানে। চড়েন দামি গাড়িতে। ব্যবসায়ী পরিচয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকায় এমন বিলাসী জীবন যাপন করেন। তিনি সেলিম চৌধুরী। সেলিম ও তাঁর স্বজনদের কাছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা পাবে ৪টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে সেলিম ও তাঁর স্বজনেরা পরিশোধ করেননি। ব্যাংকের মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। কিন্তু তাঁরা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেলিম চৌধুরী বিপিএলে দলও কিনেছিলেন। ম্যাচ গড়াপেটায় জড়িত থাকায় ২০১৪ সালে তাঁর দল ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসকে বিপিএল থেকে নিষিদ্ধ করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেলিম চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে ১১১ কোটি টাকা পাবে অগ্রণী ব্যাংকের তেজগাঁও শিল্প এলাকা শাখা। দুই দশক আগে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে কোনো টাকা পরিশোধ করেননি তাঁরা। একই সময় অগ্রণী ব্যাংকের এই শাখা থেকেই নিজের জমি মর্টগেজ দিয়ে খালাতো ভাই মনজুর আলমের নামে ৯৪ কোটি টাকা ঋণ করিয়েছিলেন সেলিম। সেই টাকাও ফেরত দেননি।
একটি জমির দলিল মর্টগেজ রেখে ইসলামী ব্যাংকের চক মোগলটুলী শাখা থেকে ১৫৪ কোটি টাকা ও রিলায়েন্স লিজিং কোম্পানি থেকে ১৫ কোটি টাকা ঋণ করিয়েছেন সেলিম চৌধুরী। এ ছাড়া সেলিম চৌধুরী ও তাঁর স্বজনদের কাছে ট্রাস্ট ব্যাংক ৫৯ কোটি টাকা ও ঢাকা ব্যাংক পাবে ১৭ কোটি টাকা।
ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সেলিম চৌধুরী শুধু ঋণ নেন, পরিশোধ করেন না। প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গে তাঁর সখ্য রয়েছে। সে কারণে বছরের পর বছর ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান তিনি।
এর মধ্যে এক মামলায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হলে দুই সপ্তাহের মধ্যে সুদ মওকুফ সুবিধার আওতায় এক কোটি টাকা দিয়ে জামিন পান সেলিম চৌধুরী। তিন মাসের মধ্যে ঋণের পুরো টাকা পরিশোধের করার শর্ত ছিল তাঁর। কিন্তু কোনো টাকাই পরিশোধ করেননি। জামিনের শর্ত ভঙ্গ করায় সেলিমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। কিন্তু পুলিশ বলছে, তিনি পলাতক।
শুধু ব্যাংকের ঋণের টাকা নয়, ইকবাল হায়দার চৌধুরী নামের এক ব্যবসায়ী বন্ধুর কাছ থেকে বাকিতে জমি লিখে নিয়ে সেই জমি একাধিক ব্যাংকে মর্টগেজ রেখে দেড় শ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেন সেলিম চৌধুরী। কিন্তু আট বছরেও ওই জমির টাকা পরিশোধ করেননি তিনি।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সেলিম চৌধুরী ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে একটি পারিবারিক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। এই সিন্ডিকেটে আছেন তাঁর স্ত্রী নাহিদ চৌধুরী, তাঁদের দুই ছেলে শিহাব হোসেন চৌধুরী ও তিশাম তামরিজ চৌধুরী। আরও আছেন সেলিমের খালাতো ভাই মনজুর আলম, মশিউর রহমান ও চাচাতো ভাই জিহান হোসাইন চৌধুরী। তাঁরা সাতটি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো নিয়ে নিয়মমাফিক আইনগতভাবে যা চলার চলছে। এখানে আমার বক্তব্যের কোনো সুযোগ নেই।’ পরে এই প্রতিবেদককে একাধিকবার ফোন করে দেখা করে বিস্তারিত বলতে চাইলেও আর দেখা করেননি।
সেলিম চৌধুরীর বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। তবে বাবা ইয়াহিয়া চৌধুরীর চাকরির সুবাদে থাকতেন খুলনায়। ১৯৯০ সালের দিকে ঢাকায় আসেন সেলিম। ইউরোপা ট্রাভেলস নামে একটি অফিস খুলে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। পরে নানা কোম্পানি খুলে ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা শুরু করেন।
অগ্রণী ব্যাংক পাবে ২০০ কোটি টাকার বেশি
ব্যাংক ও আদালত সূত্র জানায়, সেলিম চৌধুরীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মাহি নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে অগ্রণী ব্যাংকের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল করপোরেট শাখা থেকে ৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। বড় ছেলে শিহাব চৌধুরীর নামে শিহাব গার্মেন্টস লিমিটেড নামের কোম্পানি খুলে আরও ৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। আর ছোট ছেলে তিশামের নামে তিশাম অ্যাপারেলে নামের আরেকটি কোম্পানি খুলে নেওয়া হয় ছয় কোটি টাকা। কোনো টাকা পরিশোধ না করায় সুদসহ ব্যাংক এখন সেলিম ও তাঁর দুই ছেলের কাছে পাবে ১১১ কোটি টাকা।
ওই সময় অগ্রণী ব্যাংকের একই শাখা থেকে সেলিমের তাঁর জমি মর্টগেজ রেখে খালাতো ভাই মনজুর আলমের মেসার্স পটেটো ফ্ল্যাক্স বিডি লিমিটেডের নামে ৯৪ কোটি টাকা ঋণ করিয়ে নেন। গত ২৫ বছরে এই ঋণেরও কোনো টাকা পরিশোধ করেননি তাঁরা। সুদে–আসলে এই টাকা এখন আরও বেড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনজুর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কাজিন (খালাতো ভাই) সেলিম সব কিছু করেছেন। আপনি তাঁর সঙ্গে কথা বলেন।’
এক জমি একাধিক ব্যাংকে মর্টগেজ রেখে ঋণ
জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসার সুবাধে ইকবাল হায়দার চৌধুরী নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় সেলিম চৌধুরীর। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ইকবালের কাছ থেকে ঢাকার আশুলিয়া এলাকার ১০ বিঘা জমি বাকিতে খালাতো ভাই মশিউর রহমানের নামে লিখিয়ে নেন সেলিম। জমির দাম বাবদ ইকবালকে ১৭ কোটি টাকার চেক দেওয়া হয়। ওই চেক ছিল সেলিম ও তাঁর স্ত্রী নাহিদ চৌধুরীর নামে খোলা যৌথ একটি অ্যাকাউন্টের। ওই চেক জমা দিয়ে টাকা পাননি ইকবাল চৌধুরী।
পরের বছর জানুয়ারি মাসে ওই জমি মর্টগেজ রেখে তৎকালীন রিলারেন্স লিজিং কোম্পানি থেকে ১৫ কোটি টাকা ঋণ নেন সেলিমের খালাতো ভাই মশিউর। ঋণের টাকা পরিশোধ না করে তিনি লন্ডনে পালিয়ে গেছেন।
পরে ওই জমির দলিল ইসলামী ব্যাংকের চক মোগলটুলী শাখায় মর্টগেজ রেখে সেলিম তাঁর চাচাতো ভাই জিহানের মালিকানাধীন কোম্পানি মেসার্স পদ্মা অ্যাগ্রো ট্রেডার্সের নামে দুই দফায় মোট ১৫৪ কোটি টাকা ঋণ নেন। টাকা পরিশোধ না করায় ব্যাংক জিহানের বিরুদ্ধে মামলা করে। ঋণের নিশ্চয়তাদাতা (গ্যারান্টার) সেলিম চৌধুরীকেও ওই মামলায় আসামি করা হয়।
ইকবাল হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাকিতে আমার জমি লিখে নিয়ে সেই জমি দুটি ব্যাংকে মর্টগেজ রেখে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়েছেন সেলিম চৌধুরী। আমার টাকা দিচ্ছেন না। ব্যাংকের টাকাও পরিশোধ করছেন না।’ ইকবাল জানান, সেলিম চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলের নামে মামলা করেছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাঁদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।
ইসলামী ব্যাংক সূত্র জানায়, সয়াবিন, আলু ও আলুর চিপস আমদানি, পদ্মা বহুমুখী ব্রিজ, রিভার ট্রেনিং প্রকল্পসহ সরকারি কয়েকটি প্রকল্পে কোলো পাথর, ব্ল্যাক বাউলডার সরবরাহের কার্যাদেশ দেখিয়ে ২০১৬ সালে ১৬ কোটি এবং ২০১৮ সালে ১৩৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন জিহান। ঋণ পরিশোধে ২০১৮ সালে ইসলামী ব্যাংককে ৪০ কোটি টাকার একটি চেক দেন তিনি। কিন্তু অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় ওই চেক প্রত্যাখ্যাত হয়।
ইসলামী ব্যাংক চক মোগলটুলী শাখার ব্যবস্থাপক জিয়া উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা বলে ১৫৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন জিহান। বর্তমানে তাঁর কাছে সুদসহ ব্যাংকের মোট পাওনা ২০০ কোটি টাকার বেশি।
ট্রাস্ট ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে ট্রাস্ট ব্যাংকের দিলকুশা করপোরেট শাখা থেকে ৬৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল ইউরোপা বেভারেজ লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সেলিম চৌধুরী। সেলিম ঋণের কয়েকটি কিস্তি পরিশোধ করেছিলেন। তারপর আর কিস্তি দিচ্ছেন না। এই ব্যাংক এখন তাঁর কাছে ৫৯ কোটি টাকা পাবে।
এ ছাড়া ঢাকা ব্যাংক সেলিমের কাছে ১৭ কোটি টাকা পাবে। ঢাকা ব্যাংক সূত্র জানায়, সেলিম চৌধুরী ২০০৭ সাল থেকে কয়েক ধাপে ১০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এখন সুদসহ ব্যাংক তাঁর কাছে পাবে ১৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। ব্যাংক তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেও টাকা তুলতে পারছে না। ব্যাংকটির ধানমন্ডি মডেল শাখার ব্যবস্থাপক কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সেলিম ৫ বছর আগে ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছিলেন। তারপর আর টাকা দিচ্ছেন না। ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘টাকা চাইলে সেলিম চৌধুরী আমাদের হুমকি দিয়ে বলেন, টাকা দেব না। পারলে আমার থেকে টাকা তুলে নেন।’
সেলিমকে খুঁজছে পুলিশ
অগ্রণী ব্যাংক সূত্র জানায়, ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় ২০০৮ সালে সেলিম চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সেই মামলায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশ সেলিমকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের দুই সপ্তাহের মধ্যে সুদ মওকুফ সুবিধার আওতায় এক কোটি টাকা দিয়ে জামিন নেন তিনি। তিন মাসের মধ্যে ঋণের পুরো টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু কোনো টাকাই পরিশোধ করেননি। জামিনের শর্ত ভঙ্গ করায় সেলিমের বিরুদ্ধে ১২টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। কিন্তু পুলিশ বলছে, তিনি পলাতক।
এ বিষয়ে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. আ. আহাদ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেলিমের বিরুদ্ধে গুলশান ও বনানী থানার মামলায় দুটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। আমরা তাঁকে খুঁজছি।’
তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেলিম চৌধুরী গুলশান-২ নম্বরে এক্সেলসিওর কনকর্ড নামের ভবনে থাকেন। নিয়মিত অফিস করেন বনানীর হ্যামলেট টাওয়ারের সপ্তম তলায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হ্যামলেট টাওয়ারের একজন নিরাপত্তাকর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যার এখানে নিয়মিত অফিস করেন।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব ঋণখেলাপি ব্যক্তিরা পুলিশ ও ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কিনে ফেলেন। তাই তাঁদের কিছু হয় না। ৪০ বছর ধরে এটা হয়ে চলছে।’