বুশ ও পুতিন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ


আহমেদ ত্বাঈজ

*****************

মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরাকে আক্রমণ অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম’, কিন্তু সারা বিশ্বে থাকা লাখ লাখ ইরাকির কাছে সে অভিযান মোটেও তাঁদের মুক্তির অভিযান ছিল না। দুই সপ্তাহ আগে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের সেই যুদ্ধ (জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান আরও সঠিকভাবে ‘অবৈধ’ যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছিলেন) শুরু করার ২০তম বছর পূরণ হলো।

এই যুদ্ধ থেকে আমরা পশ্চিমা চোখে যুদ্ধকালীন ভণ্ডামির তকমা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। একজন ইরাকি হিসেবে ২০০৩ সালের মার্চ থেকে এ যুদ্ধের যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সেই ভয়ংকর যুদ্ধ লাখ লাখ ইরাকির মর্মান্তিক মৃত্যু ও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতি ছাড়া আর কী দিয়ে গেছে? ঘড়ির কাঁটা যেমন নিয়ম মেপে চলে, তার চেয়ে নিয়মিত ভিত্তিতে শান্তির শহর বাগদাদে নির্বিচার বোমা ফেলা হচ্ছিল।

রাতের অন্ধকার চিরে বাগদাদের আকাশে বোমার জ্বলন্ত শিখার ছবি আজও আমাদের মনে স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে ইরাকের রাতগুলো বোমার আলোয় যেন দিনে পরিণত হয়েছিল।

এ যুদ্ধের পরের বছরগুলোও ভোলার মতো নয়। ইরাক যুদ্ধের পরিণতি হিসেবে আসা উৎপীড়নমূলক দখলদারি থেকে সাম্প্রদায়িক শাসন লাখ লাখ ইরাকির জীবনকে শেষ করে দিয়েছে। এই বর্বর আগ্রাসনের যুদ্ধের কারণে আমার নিজের পরিবারের সদস্যরা আজ কানাডা থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মিথ্যা অজুহাতে ইরাকে আক্রমণ করার পর গত ২০ বছরে আমরা তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারিনি। তাঁদের দিয়ে ভুল স্বীকারও করাতে পারিনি। উল্টো আমরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বড় গলায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন্য ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলে নিন্দা করতে দেখছি।

পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধ নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুর ও অবৈধ। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান উত্তপ্ত করার ক্ষেত্রে বাইডেনের নিজের ভূমিকা কতটা? আপনাদের মনে করিয়ে দিই: বুশ ক্ষমতায় আসার আগের বছরগুলোতেই বাইডেন ইরাক যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিলেন।

ওয়াশিংটনের ‘আঘাত করো, ভয় দেখাও’ সামরিক কৌশল বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে মার্কিন বাহিনী ইরাকে নেমেই মাত্র দিন কয়েকের মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি ইরাকিকে হত্যা করে। অন্যদিকে একজন নিরপরাধ মানুষের জীবনের মূল্য সীমাহীন—এই বিবেচনা মাথায় রেখেই বলছি, গত এক বছরে ইউক্রেনে বেসামরিক লোক মরেছে প্রায় আট হাজার।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তাদের যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। ইউক্রেনের প্রতিরোধযোদ্ধারা হাতে বানানো মলোটোভ ককটেল ব্যবহার করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। কিন্তু সেই একই কাজ যখন ইরাকের মানুষ করেছেন বা এখনো ফিলিস্তিনিরা করেন, তখন পশ্চিমাদের ভাষায় তাঁরা হয়ে যান ‘সন্ত্রাসী’। পশ্চিমের এই চরম দুমুখো নীতি গত একটা বছর আমরা দেখে আসছি।

এই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ ও তাদের মিত্ররা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিসি) ইতিমধ্যে পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

কিন্তু ইরাক যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বুশ ও ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে এ ধরনের কিছু আমরা দেখিনি। ইরাক যুদ্ধে বুশ এবং ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের ভাষাগত মিলও লক্ষণীয়। ইরাক যুদ্ধে আমরা বুশকে ‘ফ্রিডম’, ‘লিবারেশন’ এবং ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ (‘ওয়ার অন টেরর’)—এই শব্দগুলো প্রায়ই বলতে শুনেছি। ঠিক একইভাবে পুতিনও ইউক্রেন থেকে ‘সন্ত্রাস’ উৎখাত করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

কী নিদারুণ পরিহাসের বিষয়, সেই বুশই গত বছর ইউক্রেন অভিযানের সমালোচনা করতে গিয়ে প্রকারান্তরে নিজেই নিজের কাজের সমালোচনা করেছিলেন। একটি ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন লোকের ইরাকে অভিযানের একক সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অন্যায্য ও অবৈধ।’ তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে মুখ ফসকে ইরাকের কথা বলে ফেলেছিলেন।

নিজেদের যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ে বুশ ও পুতিন উভয়েরই মিথ্যা ভাষ্য দাঁড় করানোর প্রবণতা দেখে গেছে। ইরাকে অভিযানের অজুহাত হিসেবে বুশ যেমন ইরাকের হাতে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার কথা বলেছিলেন, ঠিক তেমনি পুতিনও বলে আসছেন, ইউক্রেনের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে।

এই বুশ হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইরাকের ফাল্লুজা শহরে হোয়াইট ফসফরাসযুক্ত অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই রাসায়নিক অস্ত্রের কারণে এখনো ফাল্লুজা ও আশপাশের শহরের শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা নিয়ে নবজাতকদের জন্ম হয়। সে বিষয়ে বুশকে কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে হয়নি।

উল্টো তিনি নিজেকে অভিবাসীপ্রেমী চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইরাক যুদ্ধে তাঁর সাবেক দুই ‘হাত’ সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল—উভয়েই কোনো রকম বিচারের মুখোমুখি না হয়ে সসম্মান প্রয়াত হয়েছেন। সে কারণে দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বুশকেও জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।

ইরাকে অভিযান চালানোর আগের বছর বুশ আইসিসি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। এটি মার্কিন নেতা ও সামরিক কর্মকর্তাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত করাকে প্রায় অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। আইসিসির শীর্ষ কৌঁসুলি আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ২০২০ সালে তদন্ত করতে চেয়েছিলেন বলে ওয়াশিংটন তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। প্রায় একইভাবে রাশিয়া আইসিসির কৌঁসুলির বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

এ অবস্থায় পুতিনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়। কারণ, বুশের ইরাক যুদ্ধের কারণে আট লাখ ইরাকিকে প্রাণ হারাতে হয়েছে।

ইরাকে আট বছর ধরে চালানো মার্কিন উৎপীড়নের বিরুদ্ধে যাঁরাই প্রতিরোধ করতে গেছেন বা মুখ খুলেছেন, তাঁদেরই গায়ে জঙ্গি তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের অনেককেই মার্কিন সেনারা সন্ত্রাসী হিসেবে গুয়ানতানামো বে কারাগারে আটকে দিনের পর দিন শারীরিক, এমনকি যৌন নির্যাতন করেছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তাদের যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। ইউক্রেনের প্রতিরোধযোদ্ধারা হাতে বানানো মলোটোভ ককটেল ব্যবহার করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। কিন্তু সেই একই কাজ যখন ইরাকের মানুষ করেছেন বা এখনো ফিলিস্তিনিরা করেন, তখন পশ্চিমাদের ভাষায় তাঁরা হয়ে যান ‘সন্ত্রাসী’। পশ্চিমের এই চরম দুমুখো নীতি গত একটা বছর আমরা দেখে আসছি।

প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত

  • আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
  • আহমেদ ত্বাঈজ মার্কিন রাজনীতি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *