কিছু মৌলিক তথ্য …..
এম,এ হক
পুঁজিবাদের প্রথম পর্বে উপনিবেশবাদ সম্প্রসারণের নেতৃত্ব দিয়েছিল স্পেন, হল্যান্ড, ইংল্যান্ডের মতো বাণিজ্যিক এবং নৌ-শক্তির অধিকারীরা। দ্বিতীয় পর্বে নেতৃত্ব দেয় ইংল্যান্ড (কারণ তা ছিল শিল্প বিপ্লবের জন্মভূমি) এবং তৃতীয় পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা হল বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি বিপ্লবে অগ্রগণ্য এবং এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি।
সারাবিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের চেয়ে বেশী রয়েছে গোয়েন্দা এবং সামরিক ঘাঁটি। বিশ্বের প্রায় এক তৃতীআংশ দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস রয়েছে তবে পৃথিবীর প্রায় তিন চতুর্থাংশ দেশে তাদের।বিশেষ অভিযান পরিচালনার জন্য রয়েছে “স্পেশাল ফোর্স”। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৭৯৮ সাল থেকে এপর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় কমপক্ষে ৪৬৯টি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে এর অর্ধেকেরও বেশী সংগঠিত হয়েছে গত ৩০ বছরে। এক কথায়, তারা বিগত ২০০ বছরের তুলনায় এই ৩ দশকে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশী সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। আমরা যদি বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের সামরিক বাজেটের মোট ব্যয় একত্রিত করি তবে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ব্যয়ের সমান হবে না।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রধান লক্ষ্য তাদের নেতৃত্বে একটি নতুনধারার বিশ্ব প্রতিষ্ঠা। যেখানে থাকবে তাদের নিরংকুশ আধিপত্য। সাবেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার রূপ রেখা তৈরী করে। ১৯৯১ সালে মার্কিন সরকার সর্বপ্রথম ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ নামে এর পরিকল্পনা পেশ করে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ‘গ্লোবালাইজেশন’ পরিভাষাটি সবত্র প্রসার লাভ করে। যার একমাত্র উদ্দেশ্য তৃতীয় বিশ্বকে মার্কিনীদের পদানত করা।
১৯৯১ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৫০টিরও বেশী সামরিক অভিযান পরিচালিত করেছে। এই অভিযান পরিচালিত হয়েছে শুধুমাত্র বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং সম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য। বারবার শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদেই আমেরিকান সামরিক বাহিনী ব্যবহৃত হয়েছে। এটি কোনো আদর্শিক, জাতীয়তাবাদী, ধর্মীয় বা গণতান্ত্রিক প্রাক্রিয়া পুনরুদ্ধারের জন্য নয়।
মার্কিন সামরিক বাহিনী কোন দেশে প্রবেশ করে না ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়া। এত কিছু বলার কারণ হচ্ছে যখনই আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সমস্ত কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করি তখন আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হওয়াকেই বোঝাই। এটি বুঝতে হবে যখনই মানুষ বিশ্বকে একক শক্তির বলয় (গ্লোবালাইজেশন) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলতে শুরু করে। কারণ কেউ যদি বিশ্বাস করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বৈশ্বিক বিষয়ে একক শক্তির অধিকারী তাহলে তা হবে বোকার স্বর্গে বসবাসের সমতুল্য। আসলে যুক্তরাষ্ট্র কেবলমাত্র বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এক দল আর্থিক অভিজাত দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, যারা কোনো জাতির অন্তর্গত নয়। বলা যেতে পারে ‘কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ’-এর ইচ্ছার অধীন।
বিশ্বব্যাপী পুঁজির মালিক ও নিয়ন্ত্রকরাই আজ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। পুঁজিবাদ তার বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের রূপ পরিগ্রহ করে। লেনিন তাঁর “ইম্পিরিয়ালিজম : দ্য হাইয়েস্ট স্টেইজ অব ক্যাপিটালিজম” বইয়ে সাম্রাজ্যবাদকে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবেঃ ‘সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তর’ (পৃঃ ৮৮)। লেনিন আরও বলেন, ‘পুঁজিবাদের বিকাশের একটি নির্দিষ্ট স্তরে পুঁজিবাদ রূপান্তরিত হয় পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদে।’ (পৃঃ ৮৮)। সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে লেনিনীয় তত্ত্বের বিচার-বিশ্লেষণ ও সেই তত্ত্ব ঘিরে বিভিন্ন ধরনের তর্ক-বিতর্ক এখনও চলছে, যেমন চলেছে আগেও। তবে এখানে লেনিনকে আনার কারণ হচ্ছে মূলত এটাই বোঝানো যে, পুঁজিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া বর্তমান সময়ের নগ্ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে পুরোটা বোঝা মোটেই সম্ভব নয়। তারা বিশ্বের সব ব্যাপারেই আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। যতক্ষণ এ অবস্থা থাকবে ততক্ষণ কোনও প্রকৃত নিরপেক্ষ পক্ষপাতশূন্য ব্যবস্থা তৈরী হবে না। তাই বিনিয়োগকারী বা ধনীকে একটি আলাদা সত্তা হিসাবে ভাবাই শ্রেয়। তারা যে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে তাদের স্বার্থ, নিরাপত্তা এবং এজেন্ডার বাস্তবায়ন না হলে এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতেও তারা বিন্দুমাত্র পিছ পা হয় না।
আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদের প্রধান লক্ষ্য হলো পুঁজির বিকাশের অপ্রতিহত চাহিদাকে পরিপুষ্ট রাখা। এক কথায় পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করা। একই সাথে গোয়েন্দা সংস্থা, আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, সামরিক বাহিনী, এনজিও, সুশীল সমাজ – এ সমস্ত কিছুই সৃষ্টি করা হয়েছে পুঁজিবাদের এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। পুঁজির প্রবাহ যতোক্ষণ অবাধ থাকে, তার বিকাশের পথে কোনো প্রতিবন্ধক এসে দাঁড়ায় না, ততোক্ষণ সাম্রাজ্যবাদ ভদ্রতার মুখোশ পরিধান করে থাকে। কিন্তু যখনই তার গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয় কোনো কারণে তখনই সে তার প্রকৃত চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়। আর এই আবির্ভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা দেয় দেশে দেশে যুদ্ধ, সামরিক আগ্রাসন, হত্যা, নিপীড়ন সহ আরো বহু কদর্য বিষয়।
ইউরোপ জুড়ে দেখা যাচ্ছে এই নতুন ‘কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদী’ শ্রেণী পশ্চিমা দেশগুলির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, জীবনযাত্রার মান এমনকি শান্তি ক্ষুন্ন করতেও দ্বিধাবোধ করছেনা। পশ্চিমা দেশগুলির এখন আর কোনো স্বাধীন সত্তা অবশিষ্ট নেই, তারা একটি সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী শ্রেণীর অধীনস্থ, যার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে ‘কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ’-এর মুনাফায় অবদান রাখা।
আসলে লোভ আমাদের সব মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে চলেছে প্রতিনিয়ত।