চোখের আড়ালে ‘সওদাগর শাহজাদার’ মসজিদ


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দোয়েল চত্বরের উত্তর পাশে জাতীয় তিন নেতার মাজারের পেছনে অনিন্দ্যসুন্দর তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি ‘হাজি শাহবাজ মসজিদ’। তবে মসজিদটি অনেকটাই দৃষ্টির আড়ালে পড়ে গেছে

আশীষ উর রহমান

চৈত্রের খরতাপে গোলাপের পাপড়িগুলো মলিন হয়ে কিছুটা কুঁকড়ে গেছে। মাজার আর মসজিদের সীমানা আলাদা করে উত্তর–দক্ষিণে মাঝবরাবর চুন-সুরকির যে নিচু প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল, তার ওপর সারি দিয়ে রাখা হয়েছে টকটকে লাল গোলাপের মালা, আর স্তবক। গাঁদার মালাও আছে একটি–দুটি।

আশেকানেরা রোজ সকালে এসে এই প্রাচীরের ওপর এসব ফুল রেখে শ্রদ্ধা জানিয়ে যান হাজি খাজা শাহবাজের প্রতি। নতুন নয়, এই রীতি নাকি চলছে তিন শতাধিক বছর ধরে!

দৃষ্টির আড়ালে

এই মাজারটি যাঁর, সেই হাজি খাজা শাহবাজ এখন আশেকানদের কাছে পীর হিসেবে পরিচিত হলেও ইতিহাসে তাঁর পরিচয় ব্যবসায়ী হিসেবে। তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর স্থাপন করা অনিন্দ্যসুন্দর তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির জন্য। এটি ‘হাজি শাহবাজ’ মসজিদ নামেই পরিচিত। তবে মসজিদটি অনেকটাই দৃষ্টির আড়ালে পড়ে গেছে।

দোয়েল চত্বরের উত্তর পাশে জাতীয় তিন নেতার মাজারের পেছনে হাজি শাহবাজ মসজিদের অবস্থান। এর পশ্চিম দিকে ভূমি থেকে বেশ উঁচু ভিতের ওপরে নির্মিত তিন নেতার মাজারের সুউচ্চ স্থাপত্যকাঠামোর আড়ালে পড়ে গেছে মোগল আমলের এই মসজিদ। দক্ষিণ পাশে শিশু একাডেমি, পূর্ব দিকে হাইকোর্ট, উত্তরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কালীমন্দিরের স্থাপনা। ফলে শাহবাজ মসজিদটি কোনো পাশ থেকেই তেমন নজরে পড়ে না। এই মসজিদে আসার এখন একটিই পথ। সেটি তিন নেতার মাজারের উত্তর পাশের সীমানার পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে মসজিদের প্রধান ফটকের সামনে এসেছে।

‘হাজি শাহবাজ মসজিদের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ সহজেই নজর কাড়ে
‘হাজি শাহবাজ মসজিদের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ সহজেই নজর কাড়ে

স্থাপত্যরীতি

শাহবাজ মসজিদটি মোগল জমানার ঐতিহ্যবাহী শায়েস্তা খান রীতিতে তৈরি। তবে এর ভেতর ও বাইরের অলংকরণ অত্যন্ত মনোরম। ঐতিহাসিক আহমদ হাসান দানী ‘কালের সাক্ষী: ঢাকা’ বইয়ে লিখেছেন ‘স্থাপত্যের সব নমুনা ও সাজসজ্জা এমন সুন্দর ও যথাযথভাবে করা হয়েছে যে সামগ্রিকভাবে তা আকর্ষণীয়।’

এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আজমের সুবেদারির সময়। মসজিদের শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে হিজরি ১০৮৯ সন মোতাবেক ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এই পবিত্র ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদটি ভূমি থেকে বেশ খানিকটা উঁচু ভূমির ওপরে অবস্থিত। উত্তর–দক্ষিণে লম্বা। দৈর্ঘ্য ৬৮ ফুট ও প্রস্থ ২৬ ফুট। ছাদে তিনটি গম্বুজ। মাঝেরটি বড়। গম্বুজগুলোর চূড়া পদ্মপাপড়ি ও বৃত্তাকার অলংকারে শোভিত। দেয়ালের চার কোণে অষ্টভুজাকার চারটি বুরুজ মসজিদের কার্নিশ ছাপিয়ে উঠে গেছে। এর চূড়ায় রয়েছে বুরুজের আকৃতির সঙ্গে মানানসই ছোট আকরের নিরেট গম্বুজ। কিনার দিয়ে খিলান আকৃতির নকশা করা। সামনের দেয়ালেও এক গুচ্ছে তিনটি করে ‘বদ্ধখিলান’ নকশা করা।

দরজা ও মেহরাবগুলোও খিলান আকৃতির, কিনার দিয়ে খাঁজকাটা নকশা। ভেতরে পূর্ব দিকে তিনটি মেহরাব পূর্ব দিকে তিনটি ও দুই পাশে দুটি করে দরজা। পাশের দরজাগুলো এখন নকশা করা লোহার জালি দিয়ে আটকানো। ঢাকায় এ পর্যন্ত টিকে থাকা মোগল আমলের অন্যান্য মসজিদের মধ্যে এর অলংকরণগুলো ভালোভাবে আছে। দরজার চৌকাঠ এবং ওপরে খিলান কালো পাথরে তৈরি। দেয়ালের ভিত্তি করা হয়েছে চওড়া কালো পাথরের ওপর। সামনে অর্থাৎ পূর্ব দিকের দেয়ালের ভিত্তির কালো পাথরের ওপরে টানা লতাপাতার নকশা খোদাই করা।

‘ঢাকার ইতিহাস’ বইতে বলা হয়েছে, কাশ্মীর থেকে এ দেশে এসেছিলেন হাজি খাজা শাহবাজ। তিনি টঙ্গীতে বসবাস করতেন। সেখান থেকে নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসতেন

সংস্কারের অভাবে মলিন

হাজি শাহবাজ মসজিদটি পরিচালিত হয় ওয়াক্‌ফ ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে। গতকাল মঙ্গলবার জোহরের নামাজের পর কথা হলো এর মোতোয়ালি রাশেদ হোসেন ও মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল কাদের আতহারীর সঙ্গে। মোতোয়ালি জানালেন, তাঁর আগে তাঁর পিতা, পিতামহ—এভাবে বহু বহু বছর থেকে বংশপরম্পরায় তাঁরা মোতোয়ালি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মসজিদ ও মাজারটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত প্রত্নসম্পদ। কিন্তু মসজিদ সংস্কার বা পরিচালনার জন্য তাদের কোনো বরাদ্দ নেই। মসজিদের খতিব, ইমাম, মোয়াজ্জিন, খাদেমসহ লোকবল আটজন। প্রতি মাসে তাঁদের বেতন, অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এই মসজিদ পেছনে পড়ে যাওয়ায় মুসল্লির সংখ্যা কম, দানসহায়তাও পাওয়া যায় কম। দানবাক্সে যা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে বাকি খরচের অর্থ পরিচালনা কমিটির সদস্যরাই দিয়ে থাকেন। এভাবেই চলে আসছে।

অনেক দিন সংস্কার না করায় মসজিদটির বড়ই মলিন চেহারা। বাইরের রং শেওলায় ময়লায় কালচে হয়ে গেছে। ভেতরে দেয়াল থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। মোতোয়ালি জানান, ভেতরে–বাইরে সংস্কার করার এখতিয়ার তাঁদের নেই। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে বিষয়টি তাঁরা জানিয়েছেন। সেখান থেকে জানানো হয়েছে যে এ বছর বাজেট নেই। আগামী বছর বরাদ্দ পাওয়া গেলে তাঁরা মসজিদটি সংস্কার করবেন।

খাজা শাহবাজ মসজিদের ভেতর নামাজের জন্য ৪টি ও সামনের বারান্দায় ও খোলা জায়গায় ১২টি—এই ১৬টি কাতার হয়। ভেতরে প্রতি কাতারে ৪০ জন এবং বাইরে ৪২-৪৩ জন দাঁড়াতে পারেন। সব মিলিয়ে সাড়ে ছয় শর মতো মুসল্লি এই মসজিদে একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। ইমাম জানালেন, রমজানের কারণে এখন মুসল্লি বেড়েছে। প্রতি ওয়াক্তে ভেতরে ভরে গিয়ে বারান্দায় দু–তিন কাতার হয়। জুমা ও তারাবিহতে মসজিদ ভরে যায়।

কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, হাজি খাজা শাহবাজ মসজিদটি নির্মাণের পাশাপাশি  জীবদ্দশাতেই মসজিদের পাশে নিজের সমাধিটিও নির্মাণ করেন
কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, হাজি খাজা শাহবাজ মসজিদটি নির্মাণের পাশাপাশি জীবদ্দশাতেই মসজিদের পাশে নিজের সমাধিটিও নির্মাণ করেন

কে এই হাজি শাহবাজ

হাজি খাজা শাহবাজের মাজার মসজিদের পূর্ব দিকে। মসজিদের বারান্দা পার হয়ে মাজার চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। অবস্থান উত্তর দিকের সীমানাদেয়ালের পাশে। মাজারটি বর্গাকৃতির। প্রতি পাশের দৈর্ঘ্য ২৬ ফুট। ছাদে একটি গম্বুজ আর চার কোণে চারটি মিনার। মাজারের চারপাশেই খিলান আকৃতির দরজা। এখন দক্ষিণের দিকের দরজা দিয়েই প্রবেশ করতে হয়। সামনে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে খোলা চত্বর। কাঁঠালগাছের ছায়ায় ঢাকা। রাজধানীর এত হইচইয়ের ভেতরেও এই স্থানটি বেশ নিরিবিলি। অন্য রকম এক শান্ত–স্নিগ্ধ পরিবেশ।

মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা হাজি খাজা শাহবাজ এখন ‘পীর’ বা ‘আউলিয়া’ হিসেবে মান্য। ঢাকা ও ঢাকার বাইরেও তাঁর বেশ কিছু আশেকান আছেন। মসজিদের মোতোয়ালি জানালেন, হাজি শাহবাজ একজন আউলিয়া ছিলেন বলেই বংশপরম্পরায় তাঁরা জেনে ও মেনে আসছেন। হাজি শাহবাজের ‘আশেকান’ বা ভক্ত আছেন। তাঁরাই রোজ মাজারে মালা দিয়ে যান। প্রতিবছর মাঘ মাসের ১৫ থেকে ১৭ তারিখের মধ্যে এক দিন ওরস করা হয়। শতাব্দীকাল ধরে এই রেওয়াজ চলে আসছে।

হাজি খাজা শাহবাজের পরিচয় সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা প্রায় একমত। তিনি ছিলেন মোগল যুগের ঢাকার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। এ এইচ দানী তাঁকে ‘মার্চেন্ট শাহজাদা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ওই মসজিদটি নির্মাণের পাশাপাশি  জীবদ্দশাতেই মসজিদের পাশে নিজের সমাধিও নির্মাণ করেছিলেন। মুনশী রহমান আলী তায়েশ তাঁকে বলেছেন ‘সওদাগর শাহজাদা’। মসজিদের প্রস্তর ফলকে তিনি নিজেকে ‘খাজা হাজি শাহবাজ’ নামে পরিচয় দিয়েছেন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানিয়েছে এ বছর বাজেট নেই, আগামী বছর বরাদ্দ পাওয়া গেলে তারা মসজিদটি সংস্কার করবে
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানিয়েছে এ বছর বাজেট নেই, আগামী বছর বরাদ্দ পাওয়া গেলে তারা মসজিদটি সংস্কার করবে

এ ছাড়া সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর তাঁর ‘গ্লিমসেস অব ওল্ড ঢাকা’তে, আ ক ম যাকারিয়া তাঁর ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইতে এবং মুনতাসীর মামুনও তাঁকে ব্যবসায়ী বলে উল্লেখ করেছেন। তবে খাজা শাহবাজের বিস্তারিত পরিচয় তাঁরা দেননি। কিছুটা বেশি পরিচিতি রয়েছে যতীন্দ্র মোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ বইতে। তিনি জানিয়েছেন, কাশ্মীর থেকে এ দেশে এসেছিলেন হাজি খাজা শাহবাজ। তিনি টঙ্গীতে বসবাস করতেন। সেখান থেকে নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসতেন। তো জীবিতকালে হাজি খাজা শাহবাজ যে ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন তা বোঝা যায়। তিনি আধ্যাত্মিক জগতে তেমন কেউ ছিলেন কি না, ইতিহাসে তেমন কোনো উল্লেখ নেই। ব্যবসায়ী হাজি খাজা শাহবাজের ইন্তেকালের পরে যদি তাঁর পীর-দরবেশ পরিচিতি ভক্ত–আশেকানেরা পেয়ে থাকেন, তবে ইতিহাস সে বিষয়ে নীরব।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *