স্বাধীনতার চেতনাকে হেয় করছে কারা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
দৈনিক প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত
মিজানুর রহমান খান সাপ্তাহিক বিচিত্রার স্বনামধন্য সাংবাদিক ছিলেন। ডয়চে ভেলে ও পরে বিবিসিতে যোগ দেওয়ার আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সংঘটিত আন্দোলনের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের ওপর তদন্ত প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনাব খান সম্প্রতি প্রথম আলোর বিরুদ্ধে কিছু প্রচারণার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। প্রচারণাগুলো শুরু হয়েছিল প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে, যেখানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের কষ্টের অভিব্যক্তি তুলে ধরা হয়েছিল এবং মাংস, মাছ ও ভাত কেনার স্বাধীনতার (সম্ভবত সক্ষমতা অর্থে) আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছিল।
এই খবরটি থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের জন্য একটি ছবির কার্ড তৈরি করা হয়েছিল এবং সেখানে উদ্ধৃতিটি একজন দিনমজুরের হলেও ছবিটি ছিল একটি শিশুর।
প্রতিবেদনটিতে অবশ্য দিনমজুর ও শিশু দুজনেরই উদ্ধৃতি রয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং প্রথম আলোর সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে এসব পদক্ষেপ প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। এরপরও প্রতিবেদনটির মাধ্যমে প্রথম আলো স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা রেখেছে—এমন অভিযোগ এখনো করে চলেছে কিছু মহল।
মিজানুর রহমান খানের প্রতিক্রিয়াটি মূলত এ অভিযোগকে নিয়ে। সেখানে তিনি তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা ও একাডেমিক জ্ঞানের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন যে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে কোনো কটাক্ষ করা হয়নি।
তাঁর ভাষ্য, ‘আমার যখন থেকে জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে, স্পষ্ট মনে করতে পারি, বাংলাদেশের সংবাদপত্রে এ রকম ভূরি ভূরি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বছরের পর বছর খবরের কাজগুলোয় মফস্সলের পাতা কিংবা পেছনের পাতায় সচিত্র বহু ফিচার প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায় জীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেমন এত বছর পরেও ভিক্ষা করেন মুক্তিযোদ্ধা অমুক, স্বাধীনতার এত বছর পরেও রিকশা চালান বীর মুক্তিযোদ্ধা তমুক ইত্যাদি।
প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অভিযোগকারীর সংখ্যা অল্প। কিন্তু উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে তাঁরা পত্রিকার কোনো আধেয় বিশ্লেষণ না করেই এসব অভিযোগ করে যাচ্ছেন। যেকোনো যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষ বিশ্বাস করবেন যে এমন ঢালাও অভিযোগ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী। আমাদের সবার মনে রাখা প্রয়োজন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ ও গণপরিষদ বিতর্ক অনুসারে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অভীষ্ট লক্ষ্য। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই বরং মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে হেয় করা।
বীর প্রতীক তারামন বিবি সম্পর্কেও সারা দেশের মানুষ এই একই ধরনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পেরেছে। এসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় স্বাধীনতা দিবসেই। এই দিনে বিশেষ ট্রিটমেন্ট পায় এসব খবর। বক্স করে ছাপা হয়। এর সঙ্গে দেওয়া হয় বড় বড় ছবি। এই দিনে স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা হয় বলেই সংবাদপত্রে এসব খবর আলাদা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়। এখানে স্বাধীনতার মানহানির কিছু নেই।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন আরও অনেকে। তাঁদের কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছেন প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধেও। ভোটাধিকার হরণ, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি পাচার, গুম-খুনের মতো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নীরব থেকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁরা কেন সরব হয়েছেন—এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে স্বাধীনতার চেতনা প্রসঙ্গে তাঁদের উপলব্ধি নিয়েও।
এসব বাদানুবাদের যৌক্তিকতা বোঝার জন্য আমাদের নির্মোহভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। বোঝা দরকার স্বাধীনতাকে হেয় কীভাবে করা হয়, কারা করছে এসব? জানা দরকার, কী আদর্শকে সামনে রেখে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ।
২.
এককথায়, আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই মহান আদর্শগুলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানে এসব আদর্শকে সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এসব মূলনীতির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যেমন সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র বলতে প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। গণপরিষদ বিতর্ককালে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা জোর দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন।
১১ অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র বলতে এমন একটি ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে, যেখানে বাক্স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে। ফলে নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার (যেমন ৩১, ৩২, ৩৫) পরিপন্থী বলে এগুলো অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী।
মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি মহান আদর্শ সমাজতন্ত্র। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুসারে সমাজতন্ত্র বলতে শোষণমুক্ত, ন্যায়ানুগ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ ১০), অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ জনগণের প্রতিটি মৌলিক চাহিদা মেটানো (অনুচ্ছেদ ১৫), জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূর করা (১৬), অনুপার্জিত (অর্থাৎ দুর্নীতি বা অনিয়মের মাধ্যমে) আয় ভোগ করার অবসান ঘটানো (২০) ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। সে অনুসারে শোষণ ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, দুর্নীতি ও বৈষম্যকে উৎসাহিতকরণ এবং এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থতা স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী।
ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ (অনুচ্ছেদ ১২) অনুসারে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। যেমন যারা রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে ঢুকিয়েছে বা যারা বহাল রেখেছে, তারা প্রত্যেকেই চেতনাবিরোধী কাজ করেছে। অপর মূলনীতি জাতীয়তাবাদ অনুসারে বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতিবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী।
১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নকারী গণপরিষদের বিতর্কের ওপর একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ আমি সম্প্রতি রচনা করেছি। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, ওপরে বর্ণিত আদর্শগুলোই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথম আলো কি কখনো এমন কোনো সাংবাদিকতা করেছে, যা উল্লেখিত আদর্শবিরোধী?
প্রথম আলোর পাঠক হিসেবে জানি, পত্রিকাটি বরং নিরন্তরভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বিজয়গাথা ও গৌরবকে তুলে ধরেছে পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডের (যেমন ভোটাধিকার হরণ, দুর্নীতি, সম্পদ পাচার, অনিয়ম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও মৌলিক মানবাধিকারবিরোধী পদক্ষেপ) বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ও অভিমত প্রকাশ করেছে।
বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ কোনো আমলে পত্রিকাটি এ ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হয়নি। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ভুলত্রুটি, এমনকি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনা যেতে পারে। কোনো সংবাদমাধ্যমই এসব অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বা এর চেতনাবিরোধিতার অভিযোগ আনা হাস্যকর ও দুরভিসন্ধিমূলক ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে কি?
৩.
বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাহ্ফুজ আনাম তাঁর সাম্প্রতিক লেখায় স্বাধীনতার চেতনা সমুন্নত রাখা ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রথম আলোর দীর্ঘ ভূমিকার কথা সবিস্তার লিখেছেন। এরপর লিখেছেন, ‘প্রথম আলোর বিরুদ্ধে যাঁরা অভিযোগ তুলেছেন, তাঁদের যুক্তি হলো, এটা কোনো ভুল নয়, বরং “স্বাধীনতাকে” হেয় করা এবং “মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার” দীর্ঘমেয়াদি “অ্যাজেন্ডার” বাস্তবায়ন। একজন দিনমজুরের কথাকে একটি শিশুর ছবির সঙ্গে যুক্ত করে দিলেই এত কিছু করে ফেলা যায়? কোন তথ্যের ভিত্তিতে বা পত্রিকার কোন কনটেন্ট বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এসব দাবি করা হচ্ছে?’
প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অভিযোগকারীর সংখ্যা অল্প। কিন্তু উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে তাঁরা পত্রিকার কোনো আধেয় বিশ্লেষণ না করেই এসব অভিযোগ করে যাচ্ছেন। যেকোনো যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষ বিশ্বাস করবেন যে এমন ঢালাও অভিযোগ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী।
আমাদের সবার মনে রাখা প্রয়োজন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ ও গণপরিষদ বিতর্ক অনুসারে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অভীষ্ট লক্ষ্য। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই বরং মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে হেয় করা।
- আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক