সোশ্যাল মিডিয়া এবং বাক স্বাধীনতা
এম,এ হক
বাকস্বাধীনতা এমন একটি অধিকার, যা পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্তরে প্রোথিত৷ এই সব অধিকার পশ্চিমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ভিত্তি। কাজেই সঙ্গত কারণেই বাকস্বাধীনতাকে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর বলা হয়৷
বেসরকারী কোনো প্রতিষ্ঠানই গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেনি, জ্ঞানার্জনের মূল্যবোধের জন্যও তা প্রযোজ্য নয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে বাক স্বাধীনতার কোন নিশ্চয়তা নেই। ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলি মূলত একটি কর্পোরেট বিল্ডিংয়ের ভিতরে বড় রুমের মতো এবং বিল্ডিংয়ের মালিকরাই সিদ্ধান্ত নেয় যে আপনি তাদের সম্পর্কে কী ধরণের মন্তব্য করতে পারবেন। শুধুমাত্র সেখানে কিছু মানুষ জড়ো হয় বলে একে পাবলিক স্পেস ভাবা আমাদের ভুল। আমরা নিজেরা এই প্ল্যাটফর্মগুলিতে সংযুক্ত হয়েছি কারণ এগুলো আমাদেরকে দর্শকদের কাছে সহজে পৌঁছে দেয়৷ আমরা আমাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে আমাদের বক্তব্য/পণ্য হোস্ট বা পোষ্ট করতে পারি কিন্তু কেউ দেখবে না। সত্যি বলতে আমরা শেষ কবে কারো ওয়েবসাইট ভিজিট করেছি?
এই কর্পোরেট কনফারেন্স রুমগুলিতে যদি আপনি কিছু বলেন যাকে আমরা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বলে থাকি লোকেরা আপনার কথা শুনবে কিন্তু সেখানে আপনার বক্তব্য হবে সীমাবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত। কারণ এর নিয়ম আপনাকে মেনে চলতে হবে। আপনি যদি এই বিধিনিষেধ অমান্য করে যা ইচ্ছা তা বলতে চান তবে তাও করতে পারেন তবে কেউ আপনার কথা শুনবে না। আমরাই এই ধরণের পরিস্থিতি তৈরী করতে সহায়তা করেছি। সুতরাং এই প্ল্যাটফর্মের স্বত্বধিকারীরা যখন তাদের নিয়মগুলি প্রয়োগ করে তখন আমাদের অভিযোগ করা অবান্তর।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একটি মার্কিন ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম যদি গণতান্ত্রিক উদার মূল্যবোধ প্রাইভেট সেক্টরে প্রয়োগ করে তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের নির্দেশিকা হবে সংবিধান। সুতরাং আপনার বক্তব্য যদি সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত হয় তবে তা সেন্সর করা যাবে না। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবসা সংবিধানের অধীন নয় এটি একটি সমান্তরাল ক্ষমতা ব্যবস্থা। তাদের নিজস্ব নিয়ম আছে এবং তারা সেগুলিকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবেই প্রয়োগ করে। গণতন্ত্র এখানে প্রযোজ্য নয়।
ষড়যন্ত্র করে কাউকে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়। হয়ত ঐ ব্যক্তি নিয়ম নির্দেশিকা লঙ্ঘনের একেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে আর সেই কারণেই ঐ ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ আসলে সোশ্যাল মিডিয়া অভিযোগগুলি করে না অভিযোগ করে ব্যবহারকারীরা হয়ত সোশ্যাল মিডিয়া সেই অভিযোগগুলির সাথে একমত পোষণ করে এবং তখনই নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয় ৷ যদি কেউ কখনও অভিযোগ না করত তবে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টটিও নিষিদ্ধ করা হত না।
আমি মনে করি যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে বাকস্বাধীনতা বা সাধারণভাবে স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায় তা-ই বিবেচ্য। আসলে নির্ধারক বিষয়বস্তু নয় বরং এর প্রভাব। কে শুনছে বা কতজন শুনছে তার উপর ভিত্তি করেই এর প্রভাব নির্ধারিত হয়। মানে আপনি যা বলছেন তার প্রতিক্রিয়া তারা কীভাবে জানাচ্ছে।
একবার চিন্তা করুন কামাল আতাতুর্কের অধীনে তুরস্কের কথা। ফরাসীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা আযান, হিজাব এবং ইসলামের সমস্ত বাহ্যিক নিদর্শন নিষিদ্ধ করেছিল। আর ফরাসীরা আজ অবধি মনে করে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে রাষ্ট্র আরোপিত নাস্তিকতা। কিন্তু এই ফরাসীরাই বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে কথা বলে যখন কোনো কিছু তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পরে ১৯৭৮-১৯৭৯ সালের দিকে রবার্ট ফুরিসন নামক এক ফরাসী অধ্যাপক তাঁর লেখায় এবং টিভি সাক্ষাতকারে হলোকাস্ট অস্বীকার করেন, বিশেষ করে নাৎসী বাহিনীর গ্যাস চেম্বারের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। এর ফলে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তার বিরুদ্ধে চলে যায়, তিনি কয়েক স্থানে আক্রমণেরও শিকার হোন। তখন নোয়াম চমস্কি সহ প্রায় ৬০০ জন বুদ্ধিজীবী এক খোলা চিঠিতে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানান। তারা ফুরিসনের বাকস্বাধীনতার এবং মত প্রকাশের অধিকার পক্ষে দাড়ান এবং তাকে নীরব করিয়ে দেয়ার চেষ্টার প্রতিবাদ জানান। এই খোলা চিঠি ফ্রান্সে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি করে। যাক সে কথা। তবে তুরস্কে আরোপিত এই বিধিনিষেধগুলি ছিল শুধুমাত্র শহর কেন্দ্রিক তবে গ্রামীণ সমাজে তখনও আযান এবং হিজাবের প্রচলন ছিল।
পশ্চিমারা বলে মুসলিম বিশ্বে কোনো স্বাধীনতা নেই কারণ সেখানে বেশীরভাগই স্বৈরশাসক। এটা আসলে বিতর্কিত কিছু দেশে আছে কিছু দেশে নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সৎভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে পশ্চিমাদের সাথে ঐ সমস্ত মুসলিম দেশের পার্থক্য শূন্যের কোঠায়। সাধারণ মানুষ কমবেশী নির্বিঘ্নেই তাদের জীবন অতিবাহিত। শুধুমাত্র যদি না তারা প্রতিবাদী হয় বা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে চায় যখন তারা কোনো বিধিনিষেধ বা নিপীড়নের সম্মুখীন হয়। বিশ্বের সর্বত্রই এটি একরকম।
আপনি যা করবেন তার প্রভাবের উপর ভিত্তি করেই বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। যদি কোন প্রভাব না থাকে তবে কোন বিধিনিষেধও আরোপিত হবে না। পার্থক্য হল যে পশ্চিমাদের এটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে বারবার জোর দিয়ে বোঝানো যে তারা কতটা স্বাধীন। পশ্চিমাদের স্বাধীনতার কোনো বিশেষত্ব নেই, এটি কমবেশী সর্বজনীন, শুধুমাত্র কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। পশ্চিমাদের স্বাধীনতার কোন প্রভাব নেই। যে মুহূর্তে এর প্রভাব পড়বে পশ্চিমারা তাদের স্বাধীনতা হারাবে। কারণ তাদের স্বাধীনতা তাদের অপ্রাসঙ্গিকতার উপর নির্ভরশীল। যদি তাদের স্বাধীনতা কোনোভাবে এমনকি কিঞ্চিত পরিমানও পশ্চিমা ক্ষমতা ব্যবস্থার উপর হস্তক্ষেপ করে, তবে সেই ক্ষমতা ব্যবস্থা পুরোশক্তি নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। এবং সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সিরিয়া, মিশর বা অন্য কোথাও যাকে পশ্চিমারা স্বৈরাচারী বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তার থেকে আলাদা নয়। পার্থক্যটি হচ্ছে পশ্চিমের জনগণকে ধ্বংস করার জন্য পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর রয়েছে অস্ত্রের বৈচিত্র্য।
আসলে এই প্রভাবের কারণেই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছু লোককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে আমরা যা মনে করি সেরকম কোনো বাকস্বাধীনতাই নেই ।