সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিবিজড়িত বাহাদুর শাহ পার্ক


এম,এ হক

১৮৫৭ সালের এই দি‌নে (১৮ নভেম্বর) চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী প্রকাশ্য বিদ্রোহ শুরু করে।

তাঁরা জেলখানা থেকে সকল বন্দীদের মুক্তি দেয়। এরপর যত অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ আছে সব দখল করে নিয়ে; অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ত্রিপুরার দিকে যাত্রা শুরু করে অন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য।

বিদ্রোহের রেশ ঢাকাতেও পৌঁছেছিলো, হয়তো ঢাকাও জোরেশোরে অংশ নিতো এই বিপ্লবে। কিন্তু চট্টগ্রামে সিপাহীদের বিদ্রোহ দেখে ঢাকায় অভ্যুত্থানের আশংকায় কর্তৃপক্ষ ৫৪তম রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানী এবং একশ নৌ-সেনা ঢাকায় প্রেরণ করে।এছাড়া ঢাকার তৎকালীন নওয়াব খাজা আবদুল গনি ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিলেন, তাঁর ছিলো ঢাকাবাসীর উপর প্রবল প্রভাব। ফলে এই দুপক্ষ মিলে ঢাকার সিপাহীদের বিপ্লব খুব সহজেই দমন করে ফেলে। কোম্পানীর সৈন্যরা লালবাগে নিয়োজিত ২৬০ জনের ভারতীয় সেনাদলকে আক্রমণ করলে তারা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। সংঘটিত খণ্ডযুদ্ধে বেশ কিছু সিপাহী নিহত ও বন্দী হয় এবং অনেকেই ময়মনসিংহের পথে পালিয়ে যায়।

ভারতের লক্ষনৌর ‘রেসিডেন্সিতে’ সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিচিন্থগুলো সংরক্ষিত রয়েছে, আমাদের দেশে অবশ‌্য তেমন কিছু নেই। তবে র‌য়ে‌ছে যেখানে ঢাকার বিদ্রোহী সিপাহীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিলো। আর সেটিই হ‌চ্ছে বাহাদুর শাহ পার্ক। এখানেই এক সময়ে বিদ্রোহী সিপাহীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো।

ত‌বে কাগজপত্রে নাম ‘বাহাদুর শাহ’ পার্ক হলেও বেশীরভাগ মানুষ এখনও একে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামেই চিনে। বাহাদুর শাহ পার্কের বিভিন্ন সময়ের নামের পরিবর্তনটা কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। ১৮ শতকের শেষভাগে এখানে আর্মেনীয়দের একটা ক্লাব ছিলো, তারা সেখানে বিলিয়ার্ড খেলতো। বিলিয়ার্ডের সাদা গোল বলগুলো ডিমের মতো দেখতে বলে স্থানীয় বাঙ্গালীরা এই ক্লাবের নাম দিল ‘আন্ডাঘর’। ধীরে ধীরে অপভ্রংশ হয়ে আন্ডাঘর উচ্চারিত হয় ‘আন্টাঘর’ নামে। পরবর্তীকালে অর্মেনীয়দের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পরলে তারা ক্লাবটা বিক্রী করে দেয় ইংরেজদের কাছে। ইংরেজরা ক্লাব ঘরটা ভেঙ্গে একে খোলা পার্ক বানিয়ে ফেলে, তখন এটা পরিচিত হয়ে উঠে ‘আন্টাঘর ময়দান’ নামে। পার্কের চারিদিক লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিলো আর ছিলো চারকোণায় চারটি দর্শনীয় কামান। আন্টাঘর ময়দানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নবাব আব্দুল গণি ও নবাব আহসান উল্লাহ। এরপর ১৮৫৮ সালে কোম্পানী শাসনের অবসান ঘটে। রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানেই সেই সংক্রান্ত একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। তারপর থেকে আন্টাঘর ময়দানের নামকরণ হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’।
এই পার্ক এক সময় অনেক পামগাছ ছিলো। সেই পামেগাছের সারিতেই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ঢাকার ধরা পরা বিদ্রোহীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই বিদ্রোহীদের মধ্যে একজন নারীও ছিল। এখন অবশ্য সেই পুরাতন গাছগুলোর কোনটাই আর অবশিষ্ট নেই, সব কেটে ফেলা হয়েছে। বিদ্রোহী সিপাহীদের ফাঁসি দেবার পর বহুদিন পর্যন্ত আন্টাঘর ময়দানের আশপাশ দিয়ে হাঁটতে ঢাকাবাসী ভয় পেত, কারণ এ জায়গা নিয়ে বিভিন্ন ভৌতিক কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিলো।

পার্কের ভেতর গ্রানাইট পাথরের এক‌টি সৌধও আছে। সৌধ‌টি ঢাকার নবাব আবদুল গনির নাতি খাজা আফিজুল্লাহর স্মর‌ণে। ১৮৮৪ সালে খাজা আফিজুল্লাহ মারা গেলে তার বন্ধুরা চাঁদা তুলে সৌধটি নির্মাণ করেছিলেন।

খাজা আফিজুল্লাহর সৌধটির উল্টো পাশে আরেকটি স্মৃতি সৌধ আছে যা বানানো হয়েছিলো ১৯৫৭ সালে (মতান্তরে ১৯৬১)। সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে সে বছর এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করে এ পার্কের নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’।

বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট। সিপাহী বিদ্রোহের শুরুর দিকে বিদ্রোহী সিপাহীরা দিল্লীর লালকেল্লায় প্রবেশ করে নামেমাত্র মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ভারত স্বাধীন করার শপথ নেন। বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহীদের বিপ্লব তথা ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ সংবাদে কানপুর, লখ‌নৌ, বিহার, ঝাঁসি, বেরিলি থেকে শুরু করে পশ্চিম ও পূর্ববাংলার সর্বত্র সিপাহীরা গর্জে ওঠে, ‘খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম ই সিপাহী’, অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়া, বাদশাহর রাজ্য, সিপাহীর হুকুম। এরপর একের পর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে। ১৮৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমন করার পর ইংরেজরা তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে রেঙ্গুনে (বর্তমান বার্মা) নির্বাসিত করে এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

সিপাহী বিদ্রোহের প্রতি সম্মান জানাতে তাই এই পার্কটির নাম ভিক্টোরিয়া পার্কের বদলে বাহাদুর শাহ পার্ক রাখা হয়েছিলো।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *