রুশ সেনাদের কবর খুঁজতে গিয়ে পালাতে হলো দেশ থেকে


রাশিয়ার ক্রাসনোদারের বাকিনসকায়া গ্রামের কবরস্থানে ভাগনার যোদ্ধাদের কবর
রাশিয়ার ক্রাসনোদারের বাকিনসকায়া গ্রামের কবরস্থানে ভাগনার যোদ্ধাদের কবর

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার কত সেনার মৃত্যু হয়েছে—এ প্রশ্নের জবাব এখনো স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে মস্কোর ভাষ্য একটি, পশ্চিমা দেশগুলো তুলে ধরছে আরেকটি। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছিলেন রুশ অধিকারকর্মী ভিতালি ভোতানোভস্কি। রাশিয়ার বিভিন্ন কবরস্থানে রুশ সেনাদের মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করছিলেন তিনি। তবে শেষ করতে পারেননি। হুমকির মুখে ৪ এপ্রিল দেশ ছাড়তে হয়েছে তাঁকে।

ভিতালির বাড়ি রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ক্রাসনোদার অঞ্চলে। এখন রয়েছেন আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে। চেষ্টা করছেন শরণার্থী হিসেবে জার্মানিতে আশ্রয় নেওয়ার। ইয়েরেভান থেকে ভিতালির সঙ্গে কথা হয়েছে বিবিসির। তুলে ধরেছেন কী কারণে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়েছে, তার আদ্যোপান্ত।

গত বৃহস্পতিবার ভাগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিন বাকিনসকায়া গ্রামের ওই কবরস্থানটি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলতে চান তিনি।

রাশিয়ার সাবেক সেনা কর্মকর্তা ভিতালি। বিবিসিকে তিনি বলেন, গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর দিন তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। কারণ, নিজের পোশাকে ‘পুতিনকে না বলুন’, ‘যুদ্ধকে না বলুন’ লিখে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ২০ দিন কারাগারে ছিলেন। এ সময় পড়েছিল তাঁর ৫০তম জন্মদিনও।  

তবে এই বিক্ষোভের জন্য নয়, ভিতালিকে ক্রাসনোদারের মানুষ চেনেন কবর নিয়ে তাঁর সংগ্রহ করা তথ্যের কারণে। ক্রাসনোদারের বাকিনসকায়া গ্রামে একটি কবরস্থানের প্রথম সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি। সেটি এখন পরিচিত ভাগনার কবরস্থান নামে। ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী রুশ প্রতিষ্ঠান ‘ভাগনার গ্রুপ’। ইউক্রেনে রাশিয়ার পক্ষে লড়ছেন ভাগনারের যোদ্ধারা।

রাশিয়া সেন্টা পিটার্সবার্গে ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের কাছে একটি বিলবোর্ডে রাশিয়ার একজন সেনাসদস্য
রাশিয়া সেন্টা পিটার্সবার্গে ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের কাছে একটি বিলবোর্ডে রাশিয়ার একজন সেনাসদস্য

ইউক্রেনে নিহত হয়েছেন, ভাগনারের এমন অনেক যোদ্ধার শেষ ঠিকানা হয়েছে বাকিনসকায়া গ্রামের ওই কবরস্থান। বিশেষ করে নিহত যেসব যোদ্ধার পরিবারে কোনো সদস্য নেই বা তাঁদের মরদেহের খোঁজ কেউ নেননি, তাঁদের সেখানে কবর দেওয়া হয়েছে। এককালে কবরস্থানটি ছোট থাকলেও এখন আকার হয়েছে বিশাল। নতুন কবর দেওয়ার জন্য সেটি আরও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার ভাগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিন বাকিনসকায়া গ্রামের ওই কবরস্থান পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলতে চান তিনি। পরিদর্শনের সময় ভাগনার প্রধান স্বীকার করেন যে কবরস্থানটি আকারে বাড়ানো হয়েছে। বলেছিলেন, ‘এভাবেই জীবন চলে।’

ক্রাসনোদারের কবরস্থানগুলোয় রুশ সেনাদের কবরের তথ্য একপ্রকার চমকে দিয়েছিল ভিতালিকে।

ভিতালি ক্রাসনোদারের প্রতিটি কবরস্থানের খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন ২০২২ সালের মে মাসে। তিনি বলেন, ‘আমি মানুষজনের কাছে এটা প্রমাণ করতে চাচ্ছিলাম যে সেখানে (ইউক্রেনে) বিপর্যয়কর) একটা কিছু ঘটছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি এটা সবাইকে দেখাতে চাচ্ছিলাম যে যুদ্ধ সবার ও সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলে।’

ক্রাসনোদারের কবরস্থানগুলোয় রুশ সেনাদের কবরের নাম ও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন ভিতালি। কয়েক দিন আগে রাশিয়া ত্যাগের আগপর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩০০টি কবরের তথ্য তাঁর হাতে এসেছিল। সেগুলো ছিল শুধু ক্রাসনোদার অঞ্চলেরই।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে তিনি তথ্য নিতে বাসিনসকায়ার ওই কবরস্থানে যান।

কবরস্থানের কর্মীদের কাছ থেকে ভিতালি ও তাঁর সহকর্মীরা জানতে পারেন, সেখানে ভাগনার যোদ্ধাদের কবর দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন প্রথম আমরা সেখানে গেলাম, তখন ৪৮ জন ভাগনার যোদ্ধার কবর ছিল। কয়েক দিন বাদে আবার গিয়ে দেখলাম, তাঁদের কবরের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫টিতে। এরপর সেটা ১৬৪ হলো। শেষে প্রায় ২৭০টিতে গিয়ে ঠেকল।’

ক্রাসনোদারের কবরস্থানগুলোয় রুশ সেনাদের কবরের তথ্য একপ্রকার চমকে দিয়েছিল ভিতালিকে। তিনি বলেন, সত্যিটা হলো, ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনাদের মৃত্যু কয়েক গুণ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যাঁদের কবর দেওয়া হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই ভাগনার যোদ্ধা ও সেনা নিযুক্তির মাধ্যমে রুশ বাহিনীতে যুক্ত করা নতুন সেনা। পেশাদার সেনাদের কবরের সংখ্যাটা খুবই কম।  

ইউক্রেনে যুদ্ধে হতাহত হয়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কমে আসছে বলে দাবি করেছে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। গত বছরে এই সেনাঘাটতি পূরণে ‘আংশিক সেনা নিযুক্তির’ ঘোষণা দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর মাধ্যমে লাখ লাখ রুশ নাগরিককে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল।

বাখমুতে ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে ভাগনার গ্রুপ। ভাড়াটে এই সেনা দলের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিন
বাখমুতে ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে ভাগনার গ্রুপ। ভাড়াটে এই সেনা দলের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিন 

ইউক্রেনে কতজন রুশ সেনা নিহত হয়েছেন, সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে তার একটি পরিসংখ্যান দিয়েছিল মস্কো। সে সময় রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু বলেছিলেন, ইউক্রেনে তাঁদের ৫ হাজার ৯৩৭ সেনার মৃত্যু হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তিদের সঠিক হিসাব মেলানো কঠিন। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোর বেশির ভাগ কর্মকর্তা বলছেন, ইউক্রেনে ৬০ হাজারের বেশি রুশ সেনা ও যোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে।

রুশ সেনাদের মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একপর্যায়ে হুমকির মুখে পড়েন ভিতালি। তিনি বলেন, ‘যখনই আমি কবর নিয়ে প্রথম পোস্টটি করলাম, হুমকি আসা শুরু করল।’

রুশ সেনাদের মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একপর্যায়ে হুমকির মুখে পড়েন ভিতালি। তিনি বলেন, ‘যখনই আমি কবর নিয়ে প্রথম পোস্টটি করলাম, হুমকি আসা শুরু করল। দফায় দফায় হুমকি আসছিল। আমি হুমকির বার্তাগুলো সংরক্ষণ করে রাখা শুরু করলাম। তবে এত পরিমাণে হুমকি আসছিল যে পরে তা বন্ধ করি। তাঁরা হুমকি দিয়ে বলছিলেন, “আমরা তোমাকে খুন করব, তোমার টুঁটি চেপে ধরব।”’
গত সপ্তাহ পর্যন্ত এমন হুমকি এসেছে বলে জানিয়েছেন ভিতালি। বলেন, ‘গত জানুয়ারিতে আমাকে একজন ফোন করে কবরস্থানে একটি কবরের জায়গা নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। এ ধরনের তিনটি ফোনকল এসেছে। দুটি আমার কাছে আর একটি আমার গাড়িচালক ভিক্টরের কাছে।’

হুমকি প্রসঙ্গে আরেক দিনের ঘটনা তুলে ধরেন ভিতালি। সেদিন তিনি ক্রাসনোদারের একটি পুলিশ কার্যালয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ভিতালি বলেন, ‘একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে চিনতে পারলেন। বললেন, “প্রস্তুত হও।” আসলে তিনি আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে রাষ্ট্রের যে প্রতিক্রিয়া, সেটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন। আমার বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি মামলা করার যথেষ্ট সুযোগ তাঁদের হাতে ছিল।’

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে ভাগনার যোদ্ধা ও রুশ সেনাদের মৃত্যুর সঠিক তথ্য মস্কো কেন সামনে আনতে চায় না, তা-ও বিবিসিকে জানিয়েছেন ভিতালি। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের সরকারের জন্য এই পরিসংখ্যান ভয়াবহ। রাশিয়ার মানুষ মৃত্যুর সঠিক সংখ্যাটা জানেন না। ইউক্রেনে রাশিয়া কী পরিমাণ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, সেটাই শুধু আমি মানুষের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। মানুষ যদি যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যাটা জানেন, তাঁরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়বেন।

সুত্রঃ প্রথম আলো  


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *