যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে চীনের উত্থানে লাভ হচ্ছে কার?


মারুফ মল্লিক
রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরব সন্ধি স্থাপন করেছে। এ সন্ধি আরবের রাজনীতিতে গুরুত্ব বহন করছে। এর ফলে আরবের রাজনীতির খোল নলচে বদলে যেতে পারে। সম্ভবত ইয়েমেনে শান্তি ফিরে আসতে পারে। হুতিদের সঙ্গে সৌদি আরব সরকার আলোচনাও শুরু করেছে। এ সন্ধির প্রভাব অন্যান্য আরব দেশেও পড়তে পারে। কিন্তু আরবের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না; বরং নতুন করে কর্তৃত্ববাদ গেড়ে বসতে পারে। চীনকে গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তি বলে বিবেচনা করা যায় না কখনোই।

শুধু আরবেই নয়, বিভিন্ন অঞ্চলেই চীন কর্তৃত্ববাদী শাসকদের হাত করে নিজস্ব প্রভাববলয় তৈরির চেষ্টা করছে। এর কিছু নমুনা প্রতিফলিতও হচ্ছে আঞ্চলিক রাজনীতিতে। ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি না হলেও রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে চীন। এর আগে সিরিয়ার যুদ্ধেও বাশার আল–আসাদের পক্ষে ছিল চীন। তালেবানের সঙ্গেও কয়েক দফা আলোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র কাবুল ছেড়ে যাওয়ার আগে।

চীন মূলত তার অর্থনৈতিক শক্তি, অনেক আলোচিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, দক্ষ কূটনীতি ও সামরিক শক্তি দিয়ে বিভিন্ন দেশ ও শক্তিকে নিজেদের পক্ষে আনার কাজ করছে। চীনের এ ধরনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেই বর্তমান সময়কে চীনের উত্থান পর্ব বলে উল্লেখ করছেন অনেকেই। মোটাদাগে বলা যায়, বিশ্বরাজনীতিতে চীন তার পদচিহ্ন রাখছে বেশ তাৎপর্য নিয়েই। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, চীন বিভিন্ন দেশের অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে কাজ করছে। সাধারণ মানুষ ও সুশীল সমাজের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ খুব বেশি নেই। এ কারণে চীনের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিরোধী ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। চীন বিশ্বরাজনীতিতে নিজস্ব ইতিবাচক দর্শন বা আদর্শের ধারা তৈরি করতে করতে পারেনি।

চীন অগতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের অবস্থা পোক্ত করার চেষ্টা করছে। ফলে, চীনবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠছে বিভিন্ন দেশের জনসাধারণের মধ্যে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে চীনবিরোধী বিক্ষোভও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী মুক্তবাজার মডেলের বিপরীতে চীন হিউম্যান অথোরিটি বা মানুষের কর্তৃত্ব নিয়ে বিশ্ব দখল করতে চাইছে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে চীন বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদ ও কর্তৃত্ববাদকে গেড়ে বসার সুযোগ করে দিচ্ছে। এমনও বলা হচ্ছে, চীন বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদও রপ্তানি করছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, চীনের এই উত্থানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। স্বভাবতই চীন যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক আচরণের দিক থেকে বিবেচনা করলে উভয় দেশই আধিপত্যবাদী। উভয়েই কর্তৃত্ব সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে আরবসহ বিভিন্ন অঞ্চলে চীন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিনে ধরেই চীনের ঘরের কাছে চলে আসার চেষ্টা করছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের জবাব হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ইন্দো–প্যাসিফিক জোট গড়ে তুলেছে।

চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য বিস্তারের নীতির কারণে কোনো অঞ্চলেই এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বে নেই। উদাহরণ হিসেবে আরব ও দক্ষিণ এশিয়ার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র সৌদি আরব এখন ইরানের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে, এটা আগেই বলেছি। ইসরায়েলের নিরাপত্তাসহ আরবের রাজনীতিতে সৌদির নতুন নীতি যুক্তরাষ্ট্রের একক অবস্থানকে দুর্বল করবে। ইতিমধ্যেই সৌদির নীতিনির্ধারকেরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে দর-কষাকষি শুরু করেছে। এক মিসরের ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আরবের রাজনীতি আগের মতো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

ওদিকে দক্ষিণ এশিয়াতেও চীনের উপস্থিতি বাড়ছেই। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রের সংখ্যা বেশি। কিন্তু এই মিত্রদেশগুলোই চীনের বন্ধুরাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে দিন দিন। এমনকি ভারতের অবস্থানও পরিষ্কার নয়; যদিও সীমান্তে চীনের সঙ্গে ভারতের সমস্যা রয়েছে। এরপরও ভারত বর্তমানে পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান করছে—এমনটা বলা যাবে না। অথচ একসময় ভারতের চোখ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। সেই ভারতই এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের সমান্তরালে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান করছে।

মূলত সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াই দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বড় ধরনের ক্ষতি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একধরনের যুদ্ধংদেহী চরিত্র গঠন করেছে। সৌদি আরবের মতো দীর্ঘদিনের মিত্রদের একে একে হারাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু শক্তির বিপরীতে চীনের উত্থান কিন্তু কোনোভাবেই আশাপ্রদ কিছু নয়। এর কারণ হচ্ছে, চীন বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের হাত করার চেষ্টা করছে। সৌদি আরব ও ইরানের মতো চরম দুই কর্তৃত্ববাদী দেশকে এক মঞ্চে নিয়ে এসেছে। রাশিয়ার মতো গণতন্ত্রহীন দেশকে ক্রমাগত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরেই চীনের পরীক্ষিত মিত্র। গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে চীনের মৈত্রী খুবই কম। সব লৌহমানবের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব লক্ষণীয়। এসব শাসকের বিরুদ্ধে যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক অধিকার সংকোচনের অভিযোগ রয়েছে, তেমনি চীনের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান, জার্মানি ও ইতালির মতো বড় শক্তির পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদী অর্থনীতির নামে মুক্তবাজার, উদার রাজনৈতিক আচরণ, অধিকার ও মুক্তি, বাক্‌স্বাধীনতার স্লোগান দিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান তৈরির প্রয়াস নিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এই বয়ান ওই সময় মানুষকে প্রভাবিত করেছিল। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব একটি রাজনৈতিক মডেল তৈরি হয়; যদিও যুক্তরাষ্ট্রের এই মডেল নিয়ে নানাবিধ তর্ক রয়েছে। গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন পর্যন্ত করেছে। এমনকি জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক সরকারকেও ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ওই দেশের জনসাধারণ, সুশীল সমাজ ও সামরিক বাহিনীকে দক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করেছে।

সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে বিপর্যয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র আবারও এই পুরোনো মডেল নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এখন তারা আবার গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক্‌স্বাধীনতার পক্ষে নতুন করে কথা বলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো নীতিকে নতুন করে সামনে আনার কারণ হচ্ছে চীনকে মোকাবিলা করা। চীনের আধিপত্য বিস্তারের পথ আটকে দেওয়া। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজও হবে। কারণ আগেই বলেছি, চীন অগতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের অবস্থা পোক্ত করার চেষ্টা করছে। ফলে, চীনবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠছে বিভিন্ন দেশের জনসাধারণের মধ্যে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে চীনবিরোধী বিক্ষোভও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী মুক্তবাজার মডেলের বিপরীতে চীন হিউম্যান অথোরিটি বা মানুষের কর্তৃত্ব নিয়ে বিশ্ব দখল করতে চাইছে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে চীন বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদ ও কর্তৃত্ববাদকে গেড়ে বসার সুযোগ করে দিচ্ছে। এমনও বলা হচ্ছে, চীন বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদও রপ্তানি করছে।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
  • প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *