মুজিব স্বাধীনতার ঘোষক : সিআইএ পরিচালক


মিজানুর রহমান খান

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক প্রয়াত মিজানুর রহমান খান গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়েই লিখেছেন। সংবিধান ও আইন ছাড়াও ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ অনেক নথির অজানা খবরও আমরা জানতে পেরেছি তাঁর অনুসন্ধানী লেখনী থেকে। এমনই কিছু নথির খবর হলো ওয়াটারগেট খ্যাত সিআইএ পরিচালক রিচার্ড হেলমস এর ড. হেনরি কিসিঞ্জারসহ উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রকাশিত তথ্য। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা তখনই স্বীকার করা হয়েছে। বিস্তারিত জানতে পড়ুন …. 

একাত্তরের মার্চে অবিলম্বে সামরিক আইন তুলে নেয়ার চাপ দিতেই ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুজিবের আলোচনা ভেঙে যায়। গোপন বেতার বলেছে, মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং রাত ১ টায় তাকে গ্রেপ্তারের সময় পাকিস্তানি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ তার দুই সমর্থককে হত্যা করেছে।’ ওয়াটারগেট খ্যাত সিআইএ’র পরিচালক রিচার্ড হেলমস ড. হেনরি কিসিঞ্জারসহ উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের কাছে এই তথ্য প্রকাশ করেন।

আমেরিকার গোপন দলিল থেকে সম্ভবত এই প্রথমবারের মতো আরো দুটি নতুন তথ্য উদ্ঘাটিত হলো। প্রথমত, মুজিব ৪ মার্চেই একাধিক বিদেশী সংবাদদাতাকে ‘অফ দ্য রেকর্ড বলেন, ৭ মার্চে তিনি যা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন, তা স্বাধীনতার নামান্তর। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আহ্বান করা হয় পশ্চিম বার্লিন থেকে ডাকযোগে প্রেরিত এক চিঠিতে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ওয়াশিংটন সময় বিকেল ৩টা ৩ মিনিট থেকে ৩টা ৩২ মিনিট পর্যন্ত ড. হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নথিগুলো পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, একাত্তরের মার্চের দিনগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমান ও ঢাকায় তার কার্যক্রম সম্পর্কে ঘণ্টায় ঘণ্টায় নজরদারি নিশ্চিত করা হয়। কিসিঞ্জার নির্দেশ দেন পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী দৈনন্দিন ভিত্তিতে পর্যালোচনার। ২৭ মার্চের ওই বৈঠকে অন্যদের মধ্যে রাজনীতি আন্ডার সেক্রেটারি ইউ এলেক্স জনসন, প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী ডেভিড প্যাকার্ড, জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ অফিসের লেফটেন্যান্ট জেনারেল মেলবিন জয়েস, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল থেকে কর্নেল রিচার্ড টি কেনেডি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ সভায় সিআইএ পরিচালক রিচার্ড হেলমস বলেন, [সোর্স প্রদত্ত একটি বাক্য ডিক্লাসিফাই করা হলো না| মুজিবুর রহমানকে রাত ১টায় সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কাস্টডিতে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তারের সময় তার দুজন সমর্থককে হত্যা করা হয়েছে। [সোর্স প্রদত্ত দুটি বাক্য ডিক্লাসিফাই করা হলো না।] এর পরবর্তী অনুচ্ছেদটির শুরু এভাবে: [সোর্স প্রদত্ত দেড়খানা বাক্য ডিক্লাসিফাই করা হলো না।] তারা বলেন, শুক্রবার রাতে ইয়াহিয়া যে ভাষণ দিয়েছেন, সেটা কেউ নিজ কানে না শুনলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে- মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তিনি কিভাবে গরল উগরে দিয়েছেন। যা ঘটে গেছে তাতে খুব ঝামেলা পোহাতে হবে। ইসলামাবাদ নিশ্চিত করেছে যে, মুজিবুর রহমানকে সাফল্যের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কিসিঞ্জার: গতকাল মনে হয়েছিল একটা চুক্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

হেলমস: হ্যাঁ। ২৪ মার্চের কাছাকাছি সময় একটা চুক্তির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সম্ভবত তা ভেঙে গেল এ কারণে যে, মুজিবুর রহমান অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার দাবি করেছিলেন। একটি গোপন বেতার প্রচার করছে যে, মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে ২০ হাজার অনুগত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য রয়েছে। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানি ৫ হাজার নিয়মিত এবং ১৩ হাজার আধা সামরিক বাহিনী রয়েছে। কিন্তু তাদের আনুগত্য সন্দেহপূর্ণ। আমরা ভারতীয় সংবাদপত্রের এই রিপোর্ট সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারিনি যে, জাহাজযোগে বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছেছে। তবে ৬টি সি-১৩০ বিমানযোগে সৈন্যরা আজ করাচি থেকে ঢাকায় যাবে। এ জন্য তাদের অবশ্য বেশ সময় লাগবে। কারণ তাদের সিলন (শ্রীলংকা) হয়ে যেতে হবে। ঢাকায় ৭শ এবং চট্টগ্রামে ৬০-৭০ জন মার্কিন নাগরিক রয়েছে। কিন্তু তাদের সরিয়ে আনার অনুরোধ এখনো পাইনি। [একটি অনুচ্ছেদসহ সোর্স প্রদত্ত দেড়টি বাক্য ডিক্লাসিফাই করা হলো না…।)

স্বাধীনতার সমতুল্য ঘোষণা

১৯৭১ সালের ৪ মার্চ। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের স্টাফ হেরাল্ড সেন্ডার্স ও স্যামুয়েল হসকিনসন কিসিঞ্জারকে দেয়া এক স্মারকে লিখেছেন, পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ সংবাদে দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা অবনতিশীল। ১০ মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব মুজিবুর রহমান প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি কার্যত সুনির্দিষ্টভাবেই পূর্ব পশ্চিমের মধ্যে সমন্বয়ের সম্ভাবনার দরজা দড়াম করে বন্ধ করে দিয়েছেন। মুজিব একাধিক বিদেশী সংবাদদাতাদের কাছে অব দ্য রেকর্ড’ স্বীকার করেছেন, তিনি রোববার (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যা ঘোষণা করবেন, তা স্বাধীনতার সমান। তিনি অবশ্য এ কথাও বলেছেন, পূর্ব ও পশ্চিম অংশের উচিত হবে নিজেদের জন্য পৃথক সংবিধান প্রণয়ন করা। আর তার পরই কেবল দুই অংশের মধ্যে কিভাবে সংযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। মুজিবের এই মনোভাব থেকে মনে হতে পারে তিনি এক ধরনের কনফেডারেল সম্পর্কে রক্ষা করতে চাইছেন। আর সে কারণেই আমরা এই বিকল্প রাখতে চাইছি যে, আমরা যেন পূর্ব পাকিস্তানি স্বাধীনতায় স্বীকৃতি দিতে চাওয়া মাত্র ঝাঁপিয়ে না পড়ি। এ দলিলে আরো উল্লেখ করা হয়, ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি দূতাবাসের কর্মরত পূর্ব পাকিস্তানিরা স্বাধীনতার ঘোষণা এলে সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের আশঙ্কা চ্যান্সারি থেকে তারা বহিষ্কৃত হবেন। বর্তমান ডেপুটি চিফ অব মিশন একজন পূর্ব পাকিস্তানি। তিনি তখন হবেন নতুন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স।

পশ্চিম বার্লিন থেকে ডাকযোগে

১৯৭১ সালের ২২ জুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স পাকিস্তান দূতাবাসে একটি টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন। এতে তিনি প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়টি উল্লেখ করেন। বলা হয়, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২৪ এপ্রিল ১৯৭১, মুজিবনগর ডেট লাইনে প্রেসিডেন্টের বরাবরে প্রেরিত একটি ডকুমেন্ট পেয়েছে। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে ‘সার্বভৌম স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ অবিলম্বে স্বীকৃতি চেয়েছে। এই ডকুমেন্ট ‘ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট’ সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ স্বাক্ষরিত। এই ডকুমেন্টের সঙ্গে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ সংযোজিত রয়েছে। এটি পশ্চিম বার্লিন থেকে নিয়মিত আন্তর্জাতিক মেইলে এসেছে। কিন্তু খামের ওপরে ফিরতি ঠিকানা দেয়া নেই। টেলিগ্রামে মন্তব্য করা হয়, ডাক যোগাযোগের এই ধরনটি প্রশ্নসাপেক্ষ কিন্তু এটি যদি প্রকৃত হয় (এবং আমাদের এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এটি ঠিক নয়) তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি চেয়ে এটাই কিন্তু প্রথম যোগাযোগ। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানকে আগের মতোই পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ হিসেবে গণ্য করবে। কিন্তু এই ডকুমেন্ট আমাদের একটা বিপাকে ফেলেছে। আর তা হলো জনসম্মুখে আমাদের পক্ষে এখন থেকে এটা বলা কঠিন হবে যে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্বীকৃতির অনুরোধ কখনোই আমরা পাইনি। আমরা যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছি তা হলো: আমরা এই ডকুমেন্টের প্রাপ্তি স্বীকার করব না, তবে এটি আমাদের রেকর্ড সার্ভিস ডিভিশন অন্যান্য নথির মতোই সংরক্ষণ করবে। এবং আমরা এটা বলা অব্যাহত রাখব যে, পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানেরই অংশ। যদিও আমাদের কখনো জিজ্ঞেস করা হয় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের কোনো অনুরোধ কখনো আমরা পেয়েছি কিনা, তা হলে আমরা উত্তর দেব, ‘আমরা আন্তর্জাতিক ডাকযোগে পশ্চিম বার্লিন থেকে প্রেরিত একটি চিঠি পেয়েছি। কিন্তু তার কোনো ফিরতি ঠিকানা নেই। কিন্তু তাতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বীকৃতি চাওয়া হয়েছে।

লক্ষণীয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অফিস অব দ্য হিস্টোরিয়ান, যারা সম্প্রতি এসব ডকুমেন্ট ডিক্লাসিফাই করেছে তারা নিশ্চিত করেছে ওই ডকুমেন্টের হদিস তারা পায়নি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *