মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর বিমান হামলায় শতাধিক নিহত হওয়ার আশঙ্কা
- জনাথন হেড ও নিকোলাস ইয়ং
- বিবিসি নিউজ, ব্যাংকক এবং সিঙ্গাপুর
মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর বিমান হামলায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশটিতে যে গৃহযুদ্ধ চলছে তাতে একদিনে এতো ব্যাপক সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা খুব কমই ঘটেছে।
![](http://71news.it/wp-content/uploads/2023/04/Mi_35_Russian_Attack_Helicopter_6-1024x684.jpeg)
হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজন বিবিসিকে বলেছেন যে তারা অন্তত ৮০ জনের মৃতদেহ সংগ্রহ করেছেন। তবে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সাগাইং অঞ্চলের একটি গ্রামে মঙ্গলবার এই হামলা চালানো হয়।
জাতিসংঘ এই হামলার নিন্দা করেছে।
সামরিক বাহিনী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর থেকে তাদের বিরোধিতাকারীদের ওপর বিমান হামলার ঘটনা ক্রমশ বাড়িয়েই চলেছে।
সামরিক জান্তার একজন মুখপাত্র জেনারেল জ মিন টুন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলেছেন, “হ্যাঁ, আমরা এই বিমান হামলা চালিয়েছি।”
তিনি বলেন তারা পা জি জি নামের এই গ্রামটিতে হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কারণ সেখানে সামরিক বাহিনীর বিরোধী একটি গ্রুপের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি অফিস চালু করা উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।
সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতাকারী এই মিলিশিয়া গ্রুপটি পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস বা পিডিএফএস নামে পরিচিত।
কেন এই হামলা
মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা সামরিক বাহিনীর সাথে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে আসছে।
সাগাইং অঞ্চলের স্থানীয় লোকজন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
রাস্তায় সামরিক বাহিনীর গাড়ি বহরের ওপর বেশ কিছু চোরাগোপ্তা হামলা হওয়ার পর, তারা এখন আরো বেশি করে বিমান থেকে অভিযান পরিচালনা করছে। যারা তাদের শাসনের বিরোধিতা করছে তাদের বিভিন্ন স্থাপনা টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে স্কুল এবং স্বাস্থ্য ক্লিনিক। কখনো কখনো আগুন জ্বালিয়ে পুরো গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
সামরিক বাহিনী আশা করছে দেশের যেসব অঞ্চলে তারা শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ছে, এধরনের হামলার কারণে একসময় সেগুলো নিঃশেষ হয়ে যাবে।
![বই](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/1c8d/live/cc3ed2c0-d925-11ed-a5c2-11449a48c8d9.jpg)
যেভাবে হামলা চালানো হয়
পা জি জি গ্রামের একজন বাসিন্দা বিবিসিকে বলেছেন মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল সাতটার দিকে সামরিক বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান তাদের গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে যায়।
এসময় স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতারা যে ঘরে মিটিং করার জন্য জড়ো হয়েছিলেন, সেই ঘরে ওপর ওই বিমান থেকে সরাসরি একটি বোমা ফেলা হয়।
এর পরপরই একটি হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে ২০ মিনিট ধরে গ্রামটির ওপর হামলা চালানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পরে বিমানটি ফিরে আসে এবং যারা মৃতদেহ সংগ্রহের চেষ্টা করছিল তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে।
হামলার সময় গ্রামটি লোকে লোকারণ্য ছিল কারণ আশেপাশের এলাকা থেকেও লোকজন এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিল।
হামলার পর স্থানীয় বাসিন্দারা অনলাইনে কিছু ভিডিও পোস্ট করে যাতে ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
তাতে দেখা যায় ছিন্ন ভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এবং বেশ কিছু ভবনে আগুন ধরে গেছে।
গ্রামবাসীরা বলছেন তারা মৃতদেহ গুনে দেখার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে এই কাজটা করা বেশ কঠিন।
জাতিসংঘের নিন্দা
“সামরিক বাহিনীর আইনগত দায়িত্ব হচ্ছে বেসামরিক লোকজনকে রক্ষা করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের ওপর যে ধরনের আক্রমণ চালানো হয়েছে সেটা এসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন,” বলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ফলকার টুর্ক।
“সামরিক বাহিনী এবং তাদের সহযোগী মিলিশিয়ারা ২০২১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারির পর থেকে যে বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও চরম নির্যাতন করছে, তা বিশ্বাস করার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে। এসবের কোনো কোনোটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের সামিল হতে পারে,” বলেন তিনি।
![পিডিএফ মিলিশিয়াদের হামলায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয়েছে](https://ichef.bbci.co.uk/news/640/cpsprodpb/11ba/live/1d908ab0-d926-11ed-9fd5-cd81f221c5ea.jpg)
এই গৃহযুদ্ধে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। স্থানচ্যুত হয়েছে আরো প্রায় ১৪ লাখ মানুষ।
জাতিসংঘের হিসেবে দেশটির মোট জনগণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের মানবিক ত্রাণ সাহায্য প্রয়োজন।
৬০০ বিমান হামলা
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ওপর নজর রাখে এরকম একটি সংস্থা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন এন্ড ইভেন্ট ড্যাটা প্রজেক্ট অ্যাকলেডের হিসেবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কমপক্ষে ৬০০টি বিমান হামলা চালিয়েছে।
এসব হামলা চালাতে গিয়ে সামরিক বাহিনী রুশ ও চীনা বিমান ব্যবহার করছে যেগুলো থেকে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত গ্রামের ওপর বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে, যাতে ব্যাপক সংখ্যক বেসামরিক লোকজনের প্রাণহানি ঘটছে।
অভ্যুত্থানের পর গঠিত নির্বাসিত জাতীয় ঐক্যের সরকার বলছে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালে চালানো এধরনের হামলায় ১৫৫ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছে।
অক্টোবর মাসে কাচিন রাজ্যে জাতিগত বিদ্রোহীদের একটি গ্রুপের কনসার্টের ওপর বিমান বাহিনীর জেট থেকে তিনটি বোমা নিক্ষেপ করা হলে কমপক্ষে ৫০ জন প্রাণ হারান।
গত মাসে মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে লেট ইয়েট কোন গ্রামের একটি স্কুলের ওপর চালানো বিমান হামলায় অন্তত পাঁচজন শিশু নিহত এবং আরো অনেকে আহত হন।
সামরিক সরকারের প্রধান জেনারেল মিস অং হ্লাইং গত মাসে বলেছেন, সশস্ত্র গ্রুপগুলির “সন্ত্রাসী তৎপরতাকে সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে।”