মিথ্যা বলিবার মধ্যে রহিয়াছে সহস্র বিপদ


সম্পাদকীয়

ষোড়শ শতাব্দীর ব্রিটিশ লেখক স্যামুয়েল রাওল্যান্ড বলিয়াছিলেন, ‘ছোট এবং বোকারাই সাধারণত সত্য কথা বলিয়া থাকে।’ ইহা ঠিক যে, মিথ্যা বলিবার সাময়িক অনেক সুবিধা আছে; কিন্তু ইহার সবচাইতে বড় অসুবিধা হইল—ইহা সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করে। এই জন্য ইংরেজি প্রবাদেই বলা হইয়াছে—অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি। এই বেস্ট পলিসি বুঝিতে ‘বুদ্ধিমান’ হইতে হয়। সুতরাং স্যামুয়েল রাওল্যান্ডের কথাটি সঠিক নহে যে, ছোট এবং বোকারাই সত্য বলে। বরং আমরা বলিতে পারি, বোকারাই মিথ্যা বলে। মিথ্যার মাধ্যমে তাহারা তাত্ক্ষণিক লাভ করিবার সুযোগ খুঁজে; কিন্তু ইহা চাতুর্যতা। আর মিথ্যা বলিবার চাতুর্যতায় বাঙালির তুলনা চলে না। বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিকে বিস্ময়ের সহিত লক্ষ করা যায়—তাহারা চোখের উপর চোখ রাখিয়াও মিথ্যা বলিতে দ্বিধা করে না। মিথ্যা বলিতে তাহাদের বুক এবং চোখের পাতা কাঁপে না। ‘লাই ডিটেক্টর’ দিয়া টেস্ট করাইলেও হয়তো দেখা যাইবে, বাঙালি তাহাতে ধরা পড়িতেছে না। মিথ্যা বলিবার সময় তাহার হার্টবিট বাড়িতেছে না, গলা শুকাইতেছে না, কথা জড়াইতেছে না। কী অপূর্ব দক্ষতায় সত্যের মতো করিয়া মিথ্যা বলিতে পারে! 

এই চাতুর্যতা কখনো একটি জাতির মঙ্গল আনিতে পারে না। কারণ, মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী যেই কার্যপ্রণালি নির্ধারিত হয়, তাহাতে বড় ভুল হয়। সুতরাং কোনো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের ব্যক্তিরা মিথ্যা বা চাতুর্যতার আশ্রয় লইলে তাহা ঐ প্রতিষ্ঠানের জন্য আত্মঘাতী হইয়া যায়। অতএব যিনি যাহার উপযুক্ত নন, তাহার উচিত নহে তাহার জন্য নিজেকে উপযুক্ত হিসাবে ‘ভান’ করার। যিনি যেই কাজ পারিবেন না, কেন তিনি মিথ্যার আশ্রয় লইয়া তাহা করিতে যাইবেন? মহান দার্শনিক সক্রেটিস বলিয়া গিয়াছেন—‘সত্যপ্রীতি বিজ্ঞতার লক্ষণ’; কিন্তু আমরা কয়জন ‘বিজ্ঞ’ হইতে চাই? বাঙালিরা বিজ্ঞ নহে, সাময়িক লাভের জন্য বরং চালাক হইতে চাহে। এই জন্য চাতুর্যতা তাহার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যদি সে ‘মিথ্যা’ না বলে, তাহা হইলে সে ‘অর্ধসত্য’ বলিবে, তবু সহজে ‘সত্য’ বলিবে না। বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন বলিয়াছেন—অর্ধসত্য কথা বলাটাও মিথ্যার নামান্তর। অনেকে অবশ্য মনে করেন, অর্ধসত্য মিথ্যার চাইতেও ভয়ংকর।

কিন্তু কেন বাঙালির এত মিথ্যাপ্রীতি? মনস্তত্ত্ববিদরা বলিয়া থাকেন, মানুষের মনোবিকাশে শৈশব ও কৈশোরের গুরুত্ব অপরিসীম। যেই শিশু বা কিশোর দেখিতেছে যে তাহার পিতা অনিয়ম-দুর্নীতি করিয়া অর্থের পাহাড় তৈরি করিতেছে, তাহার মধ্যে কী করিয়া নীতিবোধ তৈরি হইবে? অথচ আমাদের আদর্শলিপি কিংবা ধর্মগ্রন্থসমূহে সৎ পথে চলিবার এবং চুরি না করিবার অসংখ্য নীতিবাক্য রহিয়াছে। দুর্নীতি কিংবা চুরি করা অর্থ তো হারাম। কোনো ব্যক্তি যদি হারাম কোনো বস্তুকে হারাম মনে করিয়া গ্রহণ করেন, তবে তাহার কবিরা গুনাহ হইবে। আবার যদি হারাম বস্তুকে হালাল মনে করিয়া গ্রহণ করেন, তবে পরিণতি হইবে আরো ভয়াবহ। আখিরাতে সরাসরি জাহান্নাম। এই কথা জানা থাকিলে কেন চুরি ও দুর্নীতি করে, মিথ্যার আশ্রয় লয়? নৃতত্ত্ববিদরা অবশ্য বলিয়া থাকেন যে, মানুষে মানুষে যত যোগাযোগ হয়, তাহার অধিকাংশই সত্যের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এখন যদি পারস্পরিক আস্থাই শেষ হইয়া যায়, তাহা হইলে মানুষে মানুষে যোগাযোগ টিকিয়া থাকিবে কী করিয়া? 

হজরত আলি (রা.) বলিয়াছেন, ‘যাহা সত্য নহে তাহা কখনো মুখে আনিও না। তাহা হইলে তোমার সত্য কথাকেও লোকে অসত্য বলিয়া মনে করিবে।’ আসলে সত্য কথা বলা মানে দায়িত্বশীলতা। সুতরাং যিনি মিথ্যা বলেন, তিনি দায়িত্বজ্ঞানহীতার পরিচয় দেন। মিথ্যার আরো একটি বিপদ হইল—মিথ্যা বলিবার জন্য অনেক অধিক মানসিক শক্তি খরচ করিতে হয়। এই জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলিয়াছিলেন, ‘সফল মিথ্যুক হইবার জন্য কাহারোই পর্যাপ্ত স্মরণশক্তি নাই।’ যেহেতু কাহারোই এমন স্মরণশক্তি নাই এবং মিথ্যা বলিবার এত শত বিপদ—সুতরাং সত্য বলাটাই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *