মালদ্বীপের সেনা প্রত্যাহারের ‘সময়সীমা’ ভারতকে কতটা অস্বস্তিতে ফেলেছে


উগান্ডার কাম্পালায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা জমির। ১৮ জানুয়ারি

উগান্ডার কাম্পালায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা জমির। ১৮ জানুয়ারিছবি: এএনআই

মালদ্বীপ থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়া সংক্রান্ত মোহাম্মদ মুইজ্জু সরকারের নির্দেশ ভারতকে কি খুবই অস্বস্তির মধ্যে রেখেছে? প্রশ্নটা উঠছে কারণ, সেনা অপসারণ নিয়ে ১৪ জানুয়ারি মালদ্বীপ সরকারের ঘোষণা এবং ১৫ মার্চের ‘ডেডলাইন’ নিয়ে ভারত এখনো স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। গতকাল বৃহস্পতিবার উগান্ডার কাম্পালায় জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর (ন্যাম) বৈঠকের এক ফাঁকে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা জমিরের সঙ্গে বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে যা বলেছেন, তাতেও ওই বিষয় নিয়ে বিন্দুমাত্র উচ্চবাচ্য করা হয়নি। অথচ মুসা জমির ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে স্পষ্ট লিখেছেন, মালদ্বীপ থেকে ভারতের সেনা অপসারণ প্রসঙ্গে জয়শঙ্করের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। মালদ্বীপে মোট ৮৮ জন ভারতীয় সেনা রয়েছেন। স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর এই সেনারা সে দেশকে দেওয়া ভারতের বিমান ও হেলিকপ্টার পরিষেবার তদারক করেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় উদ্ধারকাজ চালান এবং দুর্গম দ্বীপগুলোয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করে থাকেন।

ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করছিলেন। তাঁর আমলেই মালদ্বীপকে ভারত ওই বিমান ও হেলিকপ্টার দিয়েছিল। সে দেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে সমুদ্র গবেষণার জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছিল দুই দেশের মধ্যে। চলতি বছরের জুনে সেই চুক্তি নবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরই সেনা অপসারণ ও চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত জানান। ‘আউট ইন্ডিয়া’ স্লোগান দিয়েই তিনি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এখন তা কার্যকর করতে চান। ১৪ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্তা আবদুল্লাহ নাজিম ইব্রাহিম সরকারি ওই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। যেদিন ওই সিদ্ধান্তের কথা মালদ্বীপ সরকার প্রকাশ্যে জানায়, সেদিনই মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে দুই দেশের মধ্যে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কোর গ্রুপের প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর মালদ্বীপ ১৫ মার্চের ‘সময়সীমা’র কথা জানালেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রচারিত বিবৃতিতে সেনা অপসারণ নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।

ভারতের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে এই প্রসঙ্গে শুধু এটুকু বলা হয়, মানবিক কারণ ও চিকিৎসার জন্য ভারতীয় বিমান পরিষেবা বিষয়টির গ্রহণযোগ্য সমাধানের চেষ্টা নিয়ে দুই দেশের কথা হয়েছে। পরবর্তী আলোচনা দুই দেশের সুবিধামতো সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। সেই থেকে একবারের জন্যও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মালদ্বীপের সিদ্ধান্ত নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করা হয়নি। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়েও সাংবাদিকদের তরফে বারবার এই প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শুধু বলেন, ১৪ জানুয়ারি দুই দেশের কোর গ্রুপের বৈঠক হয়েছে। সমাধান সূত্রের খোঁজ চলছে। আবার দুই দেশের বৈঠক হবে। কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত, মালদ্বীপের সিদ্ধান্ত ভারতকে অস্বস্তি ও বিড়ম্বনার মধ্যে রেখেছে। দ্বিতীয়ত, ভারত চাইছে না এভাবে সেনা সরাতে। তৃতীয়ত, এই প্রশ্নে মালদ্বীপের সঙ্গে সংঘাতও সৃষ্টি করতে চাইছে না। বরং চেষ্টা চালাচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানোর। তাই যথেষ্ট সংযত প্রতিক্রিয়া জানানোর পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে চাইছে। চতুর্থত, ভারত চায় না সংঘাতের কারণে সে দেশে চীনের প্রভাব দ্রুত বেড়ে যাক। পঞ্চমত, তাই সরাসরি বিরোধের মধ্যে না গিয়ে সে দেশের ভারতপন্থী শক্তিকে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সংহত করা যায় কি না, সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মালদ্বীপ সরকারের সিদ্ধান্ত মানতে গণতান্ত্রিক ভারত বাধ্য, বিশেষ করে মালদ্বীপ সরকার যখন ভারতীয় সেনা উপস্থিতি তাদের দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে ‘অসম্মানজনক’ মনে করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর, ১৫ মার্চের মধ্যেই সেই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে ভারত সেনা সরিয়ে নেবে। তার আগে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না, যে বিমান ও হেলিকপ্টার সেখানে রয়েছে তা রাখা যাবে কি না, সেগুলো থাকলে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কয়েকজনকে রাখা যায় কি না, এসব নিয়ে দুই দেশ আলোচনা চালাচ্ছে। সেনা অপসারণের একতরফা নির্দেশ ‘অস্বস্তিকর’ হলেও তাই ভারত অসংযত কিছু করছে না। ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে মালদ্বীপের যুবা ক্যাডেটদের ভারত আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাঁরা উপস্থিত থাকবেন। সে দেশের বেশ কিছু তরুণ আমলাও প্রশিক্ষণ নিতে আসছেন হায়দরাবাদে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *