ভাগ্যকূলের জমিদার
এম, এ হক
প্রমত্তা পদ্মানদীর তীর ঘেষা ভাগ্যকূল। ভাগ্যকূলের জমিদার বংশের যেমন ছিল প্রতাপ প্রতিপত্তি তেমনি ছিল বেশুমার ধনসম্পদ। তাদের এতো ধন-সম্পত্তি ছিল যে, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাদের পূর্ববঙ্গের ধনকূবের উপাধি দিয়েছিল। ভাগ্যকূলের জমিদাররা প্রথমে ব্যবসায়ী ছিলেন। এই জমিদার পরিবারটি প্রথমে রায় এবং পরে ব্রিটিশ সরকার হতে রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন। এদের বংশ পদবী ছিল কুন্ডু। জনশ্রুতি আছে যে জমিদারদের এগারটি হিস্যা ছিল। এদের মধ্যে একটি হিস্যা ভাগ্যকূলের স্থানীয় বিখ্যাত জমিদার হরেন্দ্রলাল রায় বাহাদুর।
জমিদার হরেন্দ্রলাল রায় বাহাদুর পড়াশুনায় প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পর্যন্ত পার করতে পারেন নি। তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। ছোট বেলায় এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসক তাকে আর পড়াশুনা করতে বারন করেন। এমতাবস্থায়, তিনি নিজ বাড়ীতে গৃহশিক্ষক রেখে ইংরেজী ও বাংলায় শিক্ষার্জন করেন। সেজন্য স্কুল, কলেজ ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান করায় তার অধিক আগ্রহ ছিল। কাগজে কলমে ১৯০০ সালে জমিদার হরেন্দ্রলাল রায় বাহাদুর নিজ নামে বিক্রমপুরের ভাগ্যকূলে হরেন্দ্রলাল দ্বিমূখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভাগ্যকূল চ্যারিটেবল হাসপাতাল, মুন্সীগঞ্জ হরেন্দ্রলাল পাবলিক লাইব্রেরী, মুন্সীগঞ্জ হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করেন। জমিদার হরেন্দ্রলাল রায় বাহাদুর উদার ও দানশীল ব্যক্তি হিসেবে তদানীন্তনকালে ব্রিটিশ ভারতে বহুল আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন। ভাগ্যকূল হরেন্দ্রলাল স্কুল প্রতিষ্ঠালগ্নে ভাগ্যকূলের অন্যান্য জমিদারদের মধ্যেও স্কুল করার পক্ষে মতভেদ ছিল। ব্রিটিশ ভারতে তিনি অসংখ্য বিদ্যালয়, চ্যারিটেবল ডিসপেন্সারী, মন্দির, পানির ট্যাংক, রেসকোর্স, রাস্তাঘাট প্রতিষ্ঠায় মুক্তহস্তে দান করেছেন। তিনি দান করতে কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। দানশীল ছিলেন বলে ব্রিটিশ সরকার তাকে ১৯১৪ সালে “রায় বাহাদুর” উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর নিজস্ব স্টীমারও ছিল। তিনি পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার ওয়ারবন্ড ক্রয় করে যুদ্ধ ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় সরকারকে সহযোগীতা করেছিলেন। ভাগ্যকূলে নিজ বাড়ীর সন্নিকটে সুরম্য লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। লক্ষ্মী নারায়ণ নামে তার একটি বাইচের নৌকাও ছিল।
জমিদার হরেন্দ্রলাল রায় বাহাদুরের স্ত্রীর নাম ছিল শ্রীমতি রাধারানী। শ্রীমতি রাধারানী ভাগ্যকূলের অন্যান্য জমিদারদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে রূপবতী, নম্র ও ভদ্র। হরেন্দ্রলাল রায়ের চার পুত্র ও তিন কন্যা। তার প্রথম পুত্র নটেন্দ্রলাল রায় ভাগ্যকূল স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় কলকাতার শোভাবাজারের পৈত্রিক বাড়ীতে বেড়াতে এসে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। নটেন্দ্রলাল রায় তার আদরের পুত্র ছিল। এরপর তার কণিষ্ঠ পুত্র সরোজেন্দ্রলাল রায় বিএ পরীক্ষা চলাকালীন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে পনের দিনের মধ্যে শোভাবাজারের বাড়ীতে মৃত্যুবরণ করেন। সেটি ১৯১৭ সালের কথা। এরপর থেকে হরেন্দ্রলাল রায় মনের দিক থেকে অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছিলেন। দুই পুত্র মৃত্যুর পরে পিতা দ্বিতীয় পুত্র শ্যামেন্দ্রলাল রায়ের উপর সমস্ত বিষয় সম্পত্তির ভার ন্যস্ত করেন। ১৯৩৫ সালে তার প্রিয়তমা স্ত্রী শ্রীমতি রাধারানী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিকভাবে মারা যান। চতুর্থ পুত্র বরেন্দ্রলাল রায় মাত্র ৪৫ বছর বয়সে বহুমূত্র রোগে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর থেকে হরেন্দ্রলাল রায় বাহাদূর শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং ১৯৩৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।