পশ্চিমা নেতাদের ভন্ডামি


এম,এ হক

পশ্চিমা নেতা ও কর্মকর্তাদেরকে কখনোই বিশ্বাস করা যায় না এমনকি তারা যদি দু-একটি ভালো সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকে। স্বার্থান্বেষী পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক মন মানসিকতা এখনও বিদ্যমান। মাত্র কয়েক মাস আগেও ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন, পশ্চিমারা কী ভুল করছে। তিনি ঘোষণা করেন, ইউরোপের কোনভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ানো উচিত হবে না এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতামতের বাইরেও ইউরোপের স্বাধীন মতামত থাকা উচিত। তবুও এখন দেখা যাচ্ছে তাদের দ্বৈত নীতি। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে প্রতিহত করার জন্য ম্যাক্রোঁ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলই অনুসরণ করছে।

ম্যাক্রোঁ এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দো প্যাসিফিকের দেশগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে যেতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। যাইহোক, তাদের দুর্ভাগ্য এই অঞ্চলে চীনা মিত্ররা তাদের এই কূটকৌশলের ফাঁদে পা দেয় নি। ফরাসী প্রেসিডেন্টের দ্বৈত নীতি তখনই প্রকাশিত হয় যখন তিনি নিউ ক্যালেডোনিয়ার স্বাধীনতাকে মেনে না নিয়ে সেখানে চীনের ঘাঁটি তৈরীতে বাধ সাধেন। কিন্তু তাইওয়ান প্রসঙ্গে তারা চীনের বিরুদ্ধে একাট্টা। কিন্তু এই ভণ্ডামি সব জল্পনা কল্পনাকে ছাড়িয়ে আরও বহুদূর পর্যন্ত।
ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের জন্য পরাশক্তির প্রতিযোগীতা অকারণে নয়। এই অঞ্চল বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, এখানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬৫% এর বাস, বিশ্বের জিডিপির ৬৩% এবং বিশ্বের ৬০% সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার। দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসব অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। এসব অঞ্চলের সীমানাগুলি বাণিজ্য এবং নৌচলাচলের অবাধ যাতায়তের মাধ্যমে আবদ্ধ।

যাইহোক, এই ব্যস্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে শক্তির গতিশীলতায় এক আকস্মিক পরিবর্তন এসেছে। আর সেটি হচ্ছে অর্থনৈতিক, প্রযুক্তি, সামরিক ও রাজনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান। আর এটিই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের মাথাব্যাথার মূল কারণ, এরই প্রতিক্রিয়ায় তাদের আচরণ হয়েছে মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগীর মত। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের উত্থানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশাল কৌশলগত পরাজয় হিসেবে দেখছে।
ইতিমধ্যেই পশ্চিমা জোট চতুর্মুখী নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন কি ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তিও তৈরী করেছে যার নাম AUKUS। চীনকে মোকাবেলা করতে ইন্দো প্যাসিফিক অর্থনৈতিক কাঠামো এবং ট্রান্সপ্যাসিফিক অংশীদারিত্বও বিদ্যমান। কিন্তু এত কিছুর পরও তারা নিষ্ফল।

চীনের প্রভাবকে খর্ব করার জন্য ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে সম্প্রতি পশ্চিমাদের একটি কূটনৈতিক সফর ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। যাইহোক, তাদের সব প্রচেষ্টাই বৃথা যাচ্ছে, কারণ এই অঞ্চলে চীনের দৃঢ় অবস্থানের সামনে পশ্চিমারা পাত্তাই পাচ্ছে না।
এই রঙ্গমঞ্চে ফরাসী রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সহ অন্যান্য পশ্চিমা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। নিউ ক্যালেডোনিয়ার নিকেল সমৃদ্ধ অঞ্চল পরিদর্শনকালে ম্যাক্রোঁ বিশেষভাবে মনোযোগ কাড়েন। এটি উল্লেখ্য যে এই অঞ্চলটি স্বায়ত্তশাসিত হলেও এটি একটি ফরাসী উপনিবেশ। ফ্রান্স এখনও ঔপনিবেশিকতার যুগেই বাস করছে। চীন এখানে নৌ ঘাঁটি তৈরী করবে এরকম বানোয়াট খবর রটিয়ে ম্যাক্রোঁ জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের একটি ব্যর্থ চেষ্টাও করেছেন। যদি ভৌগলিকভাবে কৌশলগত অবস্থানে থাকা দ্বীপপুঞ্জটি স্বাধীনতা লাভ করে, তাহলে যেন স্থানীয়রা ফ্রান্সের বাধ্য হয়েই থাকে এর জন্য এটি একটি দুর্বল চক্রান্ত মাত্র। কিন্তু এখানেও ম্যাক্রোঁকে হতাশা হতে হয়।
উপরন্তু, এটি পশ্চিমাদের দ্বৈত নীতিরই প্রকাশ মাত্র। পশ্চিমারা সম্ভবত অন্ধ, কারণ তারা দেখতে পাচ্ছে না যে কীভাবে তারা এই আধুনিক যুগেও উপনিবেশবাদের সাথে জড়িত। চীনের সাথে জোটের সম্ভাবনা বন্ধ করতে তারা নিউ ক্যালেডোনিয়ার স্বাধীনতাকে দমন করতে প্রস্তুত। নিউ ক্যালেডোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আদিবাসী কন্যাক্সদেরকে নিজেদের অধিকার উপেক্ষা করে ফ্রান্সের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া গণভোটকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান ম্যাক্রোঁ। ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশ সংরক্ষণের জন্য এই অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় থেকেই তার এই ব্যর্থ প্রচেষ্টা, আর এটাই তার প্রকৃত উদ্দেশ্য।
১৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রায় ৮০টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ভানুয়াতুতে, ম্যাক্রোঁ একবার নির্লজ্জভাবে নতুন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। অথচ যেখানে রয়েছে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক আধিপত্যের নিজস্ব ইতিহাস।
একসময় ভানুয়াতু যৌথভাবে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স দ্বারা শাসিত ছিল ১৯৮০ সালে দ্বীপপুঞ্জটি স্বাধীনতা লাভ করে। এটিই স্বাধীন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ যেখানে একজন বর্তমান ফরাসী প্রেসিডেন্ট প্রথমবারের মত সফর করেন। এই সফর এই অঞ্চলে আধিপত্য জাহির করার প্রয়াস যা ক্রমবর্ধমানভাবে তার নিজস্ব পরিচয় জাহির করছে এবং স্বায়ত্তশাসন চাইছে।
পশ্চিমা নেতারা যে কতটা নির্লজ্জভাবে বিদ্রুপে লিপ্ত হতে পারে তা লক্ষণীয়। তাদের মেধা থাকা সত্ত্বেও, এই পশ্চিমা নেতারা বাস্তবতা অনুধাবনে ব্যর্থ। তাদের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কে তাদের হতাশা এবং ভয়কে প্রকাশিত করছে।
চীনের শক্তি অনস্বীকার্য এবং এর মোকাবিলায় পশ্চিমাদের প্রচেষ্টা অকেজো প্রমাণিত হচ্ছে। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল শক্তির গতিশীলতায় পরিবর্তনের নীরব সাক্ষী হতে যাচ্ছে। পশ্চিমাদের একসময়ের সুরক্ষিত আধিপত্য ধীরে ধীরে সরে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের ভণ্ডামিও প্রকাশিত হয়ে পড়ছে, এখন তারা মরিয়া হয়ে ঔপনিবেশিক আধিপত্যের অতীত যুগকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে।
তা সত্ত্বেও, চীনের অবিচল উপস্থিতি অটল এবং এই অঞ্চলের দেশগুলি ক্রমবর্ধমানভাবে এক প্রকৃত মিত্রের শক্তি এবং সমর্থনের দিকে ঝুঁকছে। যদিও পশ্চিমাদের সার্কাস সফর কিছু মুহূর্তের জন্য খবরের শিরোনাম দখল করতে পারে কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত তাদের নিজস্ব নিরাপত্তাহীনতার একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি ছাড়া আর কিছুই না।
চীনের অনুগত মিত্ররা দৃঢ় অবস্থানে থাকায় পশ্চিমাদের “বিভক্ত ও জয়”-এর কূটকৌশল অনিবার্যভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। চীনের অটল শক্তির সামনে, তারা কেবল অসহায়ভাবে তাদের প্রভাব হ্রাস হতে দেখবে। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল একটি নতুন যুগের সাক্ষী হতে যাচ্ছে, যেখানে চীনের অবস্থান অবিচল এবং অটুট। কারণ চীন তার মিত্রদের তাই দিচ্ছে যা পশ্চিমারা কখনই করতে পারেনি, “সমান শর্তে অংশীদারিত্ব”।
যখন ম্যাক্রোঁ ভানুয়াতু এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড জে অস্টিন পাপুয়া নিউ গিনি সফর করেন তখন এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স গুরুত্বপূর্ণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের অবস্থান শক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে লড়াই করছে।
তবুও চীন এই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগীতায় একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। অস্টিন যখন পাপুয়া নিউ গিনির সাথে গভীর প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, ব্লিঙ্কেন তখন AUKUS সম্প্রসারণের জন্য নিউজিল্যান্ডকে অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাব্য ইঙ্গিত ব্যক্ত করেন।
যাইহোক, এটা স্পষ্ট যে একমাত্র চীনের বিরুদ্ধে যেতে ইচ্ছুকদের জন্যই এর দরজা খোলা। কিন্তু চীনের সাথে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করায় নিউজিল্যান্ডের এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই।
টোঙ্গা সফরকালে ব্লিঙ্কেন দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জকে চীনের আচরণ এবং ধ্বংসাত্বক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সতর্ক করেন। অভিযোগগুলি এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং প্রভাব নিয়ে পশ্চিমাদের অস্বস্তিরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এখানে এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হুমকির কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যান্য দেশগুলিকে চীনের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে চায় যাতে তারা এই অঞ্চলে যা চায় তা করতে পারে। তবে এই কৌশল আর কাজ করবে না, আর এই কৌশল কাজে লাগিয়েই রাশিয়ান আক্রমণের ভয় দেখিয়ে ফিনল্যান্ডকে তারা ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই অঞ্চলে তাদের অবস্থান মজবুত করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়া এবং ফিজির সাথে বৈঠক করেছে।
ইতিমধ্যে ম্যাক্রোঁ ভারত মহাসাগরে তাদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কা সফর করেন। যাইহোক, চীনের অবিচল উপস্থিতির সামনে এটি কেবল পশ্চিমাদের নিরাপত্তাহীনতাই প্রকাশ করে।
তাছাড়া ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ব্লিঙ্কেন এবং ম্যাক্রোঁর কার্যকলাপ সাক্ষ্য দিচ্ছে তাদের অসহায়ত্বের।
কিন্তু ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের বিশ্বস্ত মিত্রদের সাথে তার অবস্থান কতটা মজবুত? দীর্ঘ ছয় বছর ধরে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ দুর্বল মার্কিন নেতৃত্বের উপর একটি প্রভাবশালী ও কার্যকরী ছায়া ফেলেছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৪৭টি দেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে যোগ দিয়েছে। চীনের কৌশল কোন বাঁধাই যেন মানে না, সামরিক আধুনিকীকরণ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রকল্প – সবক্ষেত্রেই তার অবাধ বিচরণ। আর এই দিয়েই চীন ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের মিত্র দেশগুলির মন জয় করেছে।
এমনকি ইন্দো প্যাসিফিক আঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়েও, চীনের শক্তি ও প্রভাব লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা এমন কি মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। চীন আক্ষরিক অর্থেই সবার হৃদয় জয় করছে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা চীনকে তাদের হুমকি বলে মনে করছে। সম্ভবত অন্য কোন জাতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের সাথে এধরণের স্পর্ধা দেখায় নি।
এখন কী হবে এ নিয়েই তারা বিভ্রান্ত এবং সম্ভবত দ্বিধাবিভক্তও।! কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে চীন হল সেই নতুন পরাশক্তি যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র পশ্চিমাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে মোক্ষম জবাব দিতে প্রস্তুত।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *