দুই ভাইয়ের বিরোধ থেকে যেভাবে জন্ম হলো ক্রীড়াজগতের দুই জায়ান্ট অ্যাডিডাস ও পুমার


দুই ভাই তাদের মধ্যকার বিরোধ কবর পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন। মৃত্যুর পরও তারা পাশাপাশি থাকতে নারাজ ছিলেন। অ্যাডি আর রুডলফ দুজনেই বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর যেন তাদের পাশাপাশি কবর দেওয়া না হয়, যেন যথাসম্ভব দূরে হয় দুজনের সমাধি। সেই ইচ্ছামাফিক দুজনকে একই কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হলেও দুই কবরের মাঝে ছিল বিস্তর দূরত্ব।

ডাসলার ভাইয়েরা। ছবি: অ্যাডি ও ক্যাথে ডাসলার মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন

জার্মানির ব্যাভারিয়া রাজ্যে অরাখ নদীর তীরবর্তী ছোট্ট শহর হার্জোজেনরাখ। এ শহরের বাসিন্দা দুই ডাসলার ভাই—অ্যাডলস ও রুডলফ। ১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে দুই ভাইয়ের মধ্যে বাধে ঝগড়া। দুজনের পথ বেঁকে যায় দুদিকে। ডাসলার ভাইয়েরা দুজনেই আলাদা করে জুতা ব্যবসা শুরু করেন। দুই ভাইয়ের এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই জন্ম নেয় বিখ্যাত দুই জুতোর ব্র্যান্ড পুমা ও অ্যাডিডাস। সময়ের পরিক্রমায় ক্রীড়াপণ্যের জগতে জায়ান্ট হয়ে ওঠে এ দুই কোম্পানি।

বড় ভাই রুডলফের জন্ম ১৮৯৮ সালে। আর অ্যাডলফের জন্ম ১৯০০ সালে—বন্ধুরা তাকে ডাকতেন ‘অ্যাডি’ নামে। 

ডাসলার ভাইদের বাবা কাজ করতেন জুতোর কারখানায়। সেজন্য অনেকেই মনে করতে পারেন, বাবার পেশা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই জুতার ব্যবসায় ঢোকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দুই ভাই। তবে তাদের বাবা আসলে চেয়েছিলেন, ছোট ছেলে অ্যাডি হবে রুটি ও কেক প্রস্তুতকারক আর বড় ছেলে রুডলফ হবে পুলিশ। 

কিন্তু অ্যাডির স্বপ্ন ছিল অন্যরকম। তার ইচ্ছা ছিল অ্যাথলেট হবেন। নানা ধরনের খেলায় অংশ নিতেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, কোনো খেলাতেই খেলোয়াড়দের পরার মতো উপযুক্ত জুতো নেই। অ্যাডির বিশ্বাস ছিল, নির্দিষ্ট খেলার জন্য যদি নির্দিষ্ট ধরনের জুতো বানানো যায়, তাহলে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স অনেক ভালো হবে।

কিন্তু অ্যাডি এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার পেছনে ছোটার আগেই শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে হলো অ্যাডিকে। তাকে ইউরোপে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়। 

যুদ্ধ থেকে ফিরে মায়ের শৌচাগারর ছোট একটা জুতো তৈরির কারখানা দিলেন অ্যাডি। এ কাজে তাকে সাহায্য করেন অভিজ্ঞ জুতা প্রস্তুতকারক কার্ল জেক। নিজের ওই ছোট্ট কারখানায় অ্যাথলেটিক ফুটওয়্যার ও স্যান্ডেল তৈরি করতে শুরু করলেন অ্যাডি। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা। সে কারণে জুতোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনতে হিমশিম খেতে হতো অ্যাডিকে। সেজন্য তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি থেকে সেনাবাহিনীর ফেলে দেওয়া জিনিস সংগ্রহ করতে লাগলেন। সেনা সদস্যদের ফেলে দেওয়া হেলমেট আর পানি ভরার থলির চামড়া দিয়ে জুতো তৈরি করতে শুরু করেন তিনি। আর পরিত্যক্ত প্যারাস্যুটের কাপড় দিয়ে বানাতেন চপ্পল। 

এদিকে আরেক বাধা ছিল বিদ্যুৎ। পর্যাপ্ত বিদ্যুতের সরবরাহ ছিল না তখন। সেজন্য জুতো বানানোর যন্ত্র চালাতে পারতেন না ঠিকমতো। এ সমস্যার সমাধানে অ্যাডি বাইসাইকেলের সঙ্গে চামড়া মিলিং-এর মেশিনের সংযোগ করে নিয়েছিলেন। সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে উৎপাদন করতেন বিদ্যুৎ। তা দিয়ে চলত জুতো তৈরির যন্ত্র।

দুই বছর পর অ্যাডির জুতা তৈরির ব্যবসায় যোগ দেন বড় ভাই রুডলফ। দুজনে মিলে গঠন করেন গেব্রুডার ডাসলার শুফাব্রিক নামে একটি কোম্পানি। অ্যাডির মাথায় নিত্যনতুন উদ্ভাবনী আইডিয়া আসত। তাই তিনি জুতা তৈরির কারিগরি দিকগুলোর দেখভাল করতেন। আর রুডলফ ছিলেন বিক্রি, বিপণন ও প্রচারণার দায়িত্বে। 

১৯২৫ সাল থেকে চামড়ার তৈরি ফুটবল বুট তৈরি করতে শুরু করেন ডাসলার ভাইয়েরা। এই বুটের নিচে ছিল পেরেক লাগানো (নেইলড স্টাড)। পাশাপাশি ট্র্যাকে দৌড়ানোর জুতাও তৈরি করতে থাকেন, যার নিচে বসানো থাকত স্পাইক। তাদের কোম্পানির কর্মীসংখ্যা ছিল এক ডজন। দিনে তারা ৫০ জোড়া জুতো তৈরি করত।

ডাসলার ভাইয়েরা প্রথম বড় সাফল্য পান ১৯২৮ সালের আমস্টারডাম অলিম্পিক গেমসে। ওই অলিম্পিকে ডাসলারদের কোম্পানির শ্যু পরে ৮০০ মিটার দৌড়ে সোনা জেতেন লিনা রাডকে। ওই জুতো পরে দৌড়ে তিনি নতুন বিশ্বরেকর্ডও গড়েন। লিনা রাডকের ওই রেকর্ডগড়া জয়ই অ্যাডির তত্ত্ব প্রমাণ করে দেয়—তাদের ডিজাইন করা জুতা পরে আরও দ্রুত দৌড়ানো যায়, আরও ভালো পারফরম্যান্স করা যায়। ১৯৩২ সালের লস অ্যাঞ্জেলস ও ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে প্রতিযোগীদের সবচেয়ে প্রিয় জুতো হয়ে ওঠে ডাসলার ভাইদের কোম্পানির শ্যু। ১৯৩৬ অলিম্পিকে মার্কিন ট্র্যাক-অ্যান্ড-ফিল্ড তারকা জেস ওয়েন্স তো ডাসলারদের জুতো পরে খেলে চারটি স্বর্ণপদকই জিতে নেন। ডাসলারদের জুতো সঙ্গে ওয়েন্সের এই সংযোগ কোম্পানিটির সাফল্যের জন্য রীতিমতো আশীর্বাদ হয়ে আসে। ওয়েন্সের পদক জেতার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়াজগতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় ডাসলারদের কোম্পানি, চড়চড় করে বেড়ে যায় তাদের বিক্রি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যান রুডলফ। অ্যাডি থেকে যান কোম্পানি চালানোর জন্য। যুদ্ধের কারণে তখন কাঁচামাল, বিশেষ করে চামড়ার চরম সংকট চলছে। কিন্তু এই সংকটের মধ্যেও গেব্রুডার ডাসলার শুফাব্রিক খেলোয়াড়দের জন্য জুতো উৎপাদন চালিয়ে যায়। ১৯৪৩ সালে জার্মানিতে একমাত্র তারাই খেলোয়াড়দের জুতা উৎপাদনকারী কোম্পানি ছিল। কিন্তু যুদ্ধের শেষ দুই বছর কোম্পানিটির কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় কোম্পানিটিকে জার্মানির জন্য অস্ত্র উৎপাদন করতে বাধ্য করা হয়।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দুই ভাইয়ের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে শুরু করে। দুই ভাই তাদের স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে একই বাড়িতে বাস করতেন। জনশ্রুতি আছে, যুদ্ধ চলাকালে একদিন বোমা হামলার সময় পরিবার নিয়ে বম্ব শেল্টারে আশ্রয় নেন অ্যাডি। রুডলফ আগে থেকেই সপরিবারে ওই বম্ব শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। লোকশ্রুতি অনুসারে, বম্ব শেল্টারে ঢুকেই নাকি অ্যাডি বলেছিলেন, ‘আবার এসেছে নোংরা বেজন্মারা।’ অ্যাডি কথাটা বলেছিলেন শত্রুপক্ষের যুদ্ধবিমানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু রুডলফ ভেবে বসেন, ভাইয়ের বাক্যবাণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন তিনি ও তার পরিবার।

ভাঙন ধরে দুই ভাইয়ের সম্পর্কে। গেব্রুডার ডাসলার শুফাব্রিকও ভেঙে যায়। এ কোম্পানি ভেঙে দিয়ে অ্যাডি গঠন করেন ‘অ্যাডিডাস’। এ নামে নিজের কোম্পানির উৎপাদন চালিয়ে যান তিনি। 

অন্যদিকে রুডলফ তার ব্যবসা নিয়ে চলে যান নদীর অপর তীরে। সেখানে তিনি রুডা নামে একটি কোম্পানি খোলেন, পরবর্তীতে এর নাম দেন ‘পুমা’। 

এ পরিবারের সঙ্গে শহরটিও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। কর্মীরাও যার যার পছন্দমতো নিয়োগদাতা বেছে নেয়। কেউ যোগ দেয় অ্যাডিডাসে, কেউ যায় পুমায়। দুই পক্ষের মধ্যে সৃষ্টি হয় তীব্র বিরোধ। নদীর দুই তীর চলে যায় দুই পক্ষের দখলে। অ্যাডিডাস ভক্ত কেউ অ্যাডিডাসের জুতো পরে পুমার এলাকায় গেলে তার কপালে খারাবি ছিল। দুই পক্ষেরই নিজেদের বেকারি, বার, স্পোর্টস ক্লাব গড়ে ওঠে। 

দুই ভাইয়ের এই দ্বন্দ্বের ফায়দাও নিত অনেকে। যেমন, অনেকসময় কাজের লোকেরা রুডলফের বাড়িতে কাজ করতে যেত অ্যাডিডাসের জুতা পরে। তা দেখে রুডলফ রেগে গিয়ে তাদেরকে তার বাড়ির বেজমেন্ট থেকে পুমার জুতো এনে পরতে বলতেন। এ জুতো তারা বিনামূল্যেই পেয়ে যেত।

দুই ভাই তাদের মধ্যকার বিরোধ কবর পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন। মৃত্যুর পরও তারা পাশাপাশি থাকতে নারাজ ছিলেন। অ্যাডি আর রুডলফ দুজনেই বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর যেন তাদের পাশাপাশি কবর দেওয়া না হয়, যেন যথাসম্ভব দূরে হয় দুজনের সমাধি। সেই ইচ্ছামাফিক দুজনকে একই কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হলেও দুই কবরের মাঝে ছিল বিস্তর দূরত্ব।

তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। রুডলফ ডাসলারের নাতি ফ্রাঙ্ক ডাসলার বড় হয়েছেন পুমার জুতো পরে। কিন্তু তিনি এখন চাকরি করেন অ্যাডিডাসে, কোম্পানিটির প্রধান আইনি পরামর্শদাতা হিসেবে। প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবারে যোগ দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত অবশ্য তার পরিবার অত ভালোভাবে নেয়নি। শহরেও অনেকে ভুরু কুঁচকেছে তার এই সিদ্ধান্তে। তবে ফ্রাঙ্ক এসব কিছুকে পাত্তা দেননি।

তিনি বলেন, ‘এ শত্রুতা ছিল বহু বছর আগে, এখন এসব ইতিহাস।’

১৯৮৭ সালে অ্যাডলফ ডাসলারের ছেলে হর্স্ট ডাসলার অ্যাডিডাস বিক্রি করে দেন ফরাসি শিল্পপতি বার্নার্ড টাপি-র কাছে। অন্যদিকে পুমার ৭২ শতাংশ শেয়ারও সুইস ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কোসা লিয়েবারমান এসএ-র কাছে বিক্রি করে দেন রুডলফের ছেলে আরমিন ও জার্ড ডাসলার। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে কোম্পানি দুটির মালিকানা আর দুই পরিবারের হাতে নেই। এছাড়া দুই কোম্পানির শ্রমশক্তিতেও বৈচিত্র্য এসেছে। এখন কোম্পানি দুটির সিংহভাগ কর্মীই শহরের বাইরের লোক। আর শহরের অল্প যে কজন এখনও কোম্পানি দুটিতে চাকরি করছে, তাদের মধ্যেও আগের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁঝ নেই। দুই কোম্পানির কর্মীরা রাস্তায় দেখা হলে পরস্পরের কাপড়চোপড় নিয়ে টিপ্পনী কাটে ঠিকই, কিন্তু এখন এসব করা হয় নেহাতই মজা করার জন্যে।

সুত্রঃ টিবিএস নিউজ


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *