চীন-সৌদি সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যে কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাবে
চীনের নেতৃত্বাধীন সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় (এসসিও) সম্প্রতি যোগ দিয়েছে সৌদি আরব। চীন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এশিয়ার নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক এই ব্লককে সম্প্রসারণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এসসিওর বেশির ভাগ সদস্যই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসা দেশ। রয়েছে রাশিয়া ও চীন। এ ছাড়া বিশ্বের বড় শক্তির মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রও এই সংস্থার সদস্য। সর্বশেষ গত মাসের শেষ দিকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব এতে যোগ দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের ভূমিকা বেশ জোরালোভাবে দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে ওয়াশিংটনের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমন এবং ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে চীনের মধ্যস্থতায় গত মার্চে প্রতিন্দ্বন্দ্বী দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। সর্বশেষ ৬ এপ্রিল চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুবরাজ ফয়সাল বিন ফারহান বৈঠকে বসেন।
চীনের অপরিশোধিত তেলের বড় সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে সৌদি আরব। উল্টোভাবে বললে, সৌদি আরবের রপ্তানি তেলের বড় অংশের গন্তব্য হচ্ছে চীন। তবে সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক বেশ গভীরে, তাদের তেলের বিনিময় মুদ্রা সব সময় ঠিক হয় ডলারে।
বৈঠকের পর ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, বৈঠকে মন্ত্রীরা দুই দেশে দূতাবাস ও কনস্যুলেট আবার চালুর পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক পুনরুদ্ধার এবং দুই দেশের দূতাবাস ও কনস্যুলেট আবার চালুর বিষয়ে নির্বাহী পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছেন।
শুধু ইরানের সঙ্গে নয়, চীনের সঙ্গেও জ্বালানি সম্পর্ক শক্তিশালী করছে সৌদি আরব। ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার দিয়ে চীনের রংসেং পেট্রোকেমিক্যালের ১০ শতাংশ শেয়ার কেনার চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির আওতায় চীনের এই কোম্পানিকে দৈনিক ৪ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল অশোধিত তেল সরবরাহ করবে সৌদি আরব।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া বিশ্বে নতুন মেরুকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ তাদের বৈশ্বিক অংশীদারদের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু সৌদি আরবের মতো দেশ যখন চীনের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, তখন বিষয়টি গুরুত্বের দাবি রাখে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থায় এখনো না গেলেও চীন ধীরে ধীরে সেই পথে হাঁটছে কি না—এই প্রশ্নও উঠছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের একচেটিয়া ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক বোধহয় শেষ হতে চলেছে। আমরা এখন আরও বেশি খোলামেলা সম্পর্কের দিকে যাচ্ছি
আলী শিহাবি, সৌদি বিশ্লেষক ও লেখক
সৌদি বিশ্লেষক ও লেখক আলী শিহাবি যেমনটা বলছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের একচেটিয়া ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক বোধহয় শেষ হতে চলেছে। আমরা এখন আরও বেশি খোলামেলা সম্পর্কের দিকে যাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক আছে, ঠিক আছে। তবে সমানতালে আমরা চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চাই।’
আলী শিহাবি বলেন, বিভিন্ন পক্ষ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রভাব নিয়ে আলোচনার টেবিল আসছে। এতে একধরনের মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে। এখন সৌদি আরবের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলাই হবে বিচক্ষণ কাজ।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত প্রিন্সেস রিমা বিনতে বন্দর আল–সউদ গত অক্টোবরে সিএনএনকে বলেছিলেন, সৌদি–যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের পর্যালোচনা অবশ্যই একটি ‘ইতিবাচক বিষয়’।
রাষ্ট্রদূত বলেন, পাঁচ বছর বা ১০ বছর আগে সৌদি আরব যেমন ছিল, এখন আর তেমনটি নেই। সুতরাং এখন সব বিশ্লেষণকে একইভাবে প্রাসঙ্গিক বলা যাবে না। তবুও বলতে হয়, সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখনো অনেক বেশি বিস্তৃত ও শক্তিশালী।
সিএনএনের সঙ্গে আলাপকালে জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (এসএআইএস) মিডল ইস্ট স্টাডিজ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফায়ার্সের অধ্যাপক ভালি নসর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। কারণ, সৌদি আরবের বিষয়ে পুরোপুরি ভিন্ন ধারণা পোষণ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ, বেইজিং এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক দিকটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে তারা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে আগ্রহী নয় বলে মনে হয়। আবার সৌদি–চীন সম্পর্ক পূর্ণমাত্রার মৈত্রীরূপ নেবে বলেও মনে হচ্ছে না।
চীনের অপরিশোধিত তেলের বড় সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে সৌদি আরব। উল্টোভাবে বললে, সৌদি আরবের রপ্তানি তেলের বড় অংশের গন্তব্য হচ্ছে চীন। তবে সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক বেশ গভীরে, তাদের তেলের বিনিময় মুদ্রা সব সময় ঠিক হয় ডলারে। সৌদির প্রতিরক্ষা অবকাঠামো পুরোপুরি মার্কিন সরঞ্জামের ওপর নির্ভরশীল।
আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসী জ্যেষ্ঠ ফেলো জোনাথন ফুলটন বলছেন, চীনের বেশ কঠোর জোট–নিরপেক্ষ নীতি রয়েছে। তারা হঠাৎ করে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে জড়াতে চাইবে না।
ফুলটন বলেন, ‘সাধারণত তৃতীয় কোনো দেশ বা কয়েকটি দেশের ব্লকের বিপক্ষে থাকে—এমন দেশগুলোর মধ্যে মৈত্রী হয় থাকে। কিন্তু চীন এমন কোনো কিছু করতে চায় না। তারা অন্য কোনো দেশের ইস্যুতে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল সংঘাতে নিজেদের জড়াতে চাইবে না।
গত বছর রিয়াদে ঐতিহাসিক সফরে গিয়েছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং। তখন তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, পশ্চিমা দেশ থেকে তাদের নীতি কিছু ভিন্ন। তাঁদের নীতিই হচ্ছে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানো। সুতরাং সৌদির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা হস্তক্ষেপ না করার নীতিতেই থাকবে।
ফুলটন বলেন, দুই দেশেরই একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ, এক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের খুব একটা স্বার্থ নেই। দুটি দেশেরই মৌলিক স্বার্থের অগ্রাধিকার ভিন্ন ভিন্ন।
চীনের এই নীতি সৌদি আরবের জন্য বেশ পছন্দ হতে পারে। সৌদি আরবের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে বাইডেন প্রশাসন বিস্তর সমালোচনা করেছে, যা নিশ্চয় তাদের পছন্দ নয়। চীন চায়, দেশটির উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলীয় উইঘুর মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু মুসলিমদের নির্যাতনের বিষয়ে সৌদি আরব আগের মতোই চুপ থাকবে। ২০২১ সালে উইঘুরদের নির্যাতনের ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্র ‘গণহত্যা’ বলে উল্লেখ করেছিল।
গত মাসে আকস্মিক সৌদি-ইরান চুক্তির ঘোষণার পর বাইডেন প্রশাসন চীনের ভূমিকাকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, সৌদির বিরুদ্ধে ইরানি হামলা প্রতিরোধসহ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের চাপে তেহরান আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়েছে। যেই আলোচনায় বসুক, তাকে তাঁরা স্বাগত জানান।
ফুলটন বলেন, চীনের মধ্যস্থতা তার মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরিবর্তন আনবে বলে মনে হয় না। আঞ্চলিক সমস্যাকে আঞ্চলিক উদ্যোগেই সমাধান করতে হবে। আঞ্চলিক প্রভাবশালী নেতারাও বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।