কাজী সালাউদ্দিনের সংবাদ সম্মেলন ও তিন পক্ষকে চটিয়ে তোলা


বাফুফে প্রেসিডেন্ট কাজী সালাউদ্দিন

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে কাজী সালাউদ্দিন গত একযুগ ধরে বেশ দোর্দণ্ড প্রতাপের সাথেই বহাল আছেন। সম্প্রতি একটি সংবাদ সম্মেলনে মি. সালাউদ্দিন অনেকটা আচমকাভাবে ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসানকে ইঙ্গিত করে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসেন।

চটিয়েছেন বিসিবি প্রেসিডেন্টকে

এরপর চুপ থাকেননি ক্রিকেট বোর্ড প্রেসিডেন্ট। তিনিও কাজী সালাউদ্দিনকে পাল্টা কথা ছুঁড়ে দিয়েছেন। এপ্রিল মাসের তিন তারিখের সেই সংবাদ সম্মেলনে, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ছাড়াও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপনকে ইঙ্গিতে ব্যঙ্গ করেন কাজী সালাউদ্দিন।মিয়ানমারে চলমান অলিম্পিক বাছাই পর্বের ফুটবলে বাংলাদেশের নারী দল অংশ নিতে যায়নি কেন? এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছিল। সেখানে বাফুফে সভাপতি কাজি সালাউদ্দিন বলেন, টাকার সংকট থাকার কারণে নারী ফুটবল দলকে পাঠানো যায়নি। এজন্য ২০ লাখ টাকার প্রয়োজন ছিল। সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে টাকা নিয়ে নারী ফুটবল দলকে মিয়ানমারে পাঠানো যেতো কিনা?

এসময় মি. সালাউদ্দিন কানে ফোন নেয়ার মতো ভঙ্গি করে, “লোক দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন দেয়া আমার চরিত্র নয়।” তার সেই ভঙ্গি ও কথায় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসানের প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল।বিসিবি প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন প্রায়শই বলে থাকেন, বাংলাদেশের ম্যাচের পর ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ক্রিকেটের ভালো-মন্দ নিয়ে কথা হয়’। কাজী সালাউদ্দিনের এই বক্তব্য নিয়ে যখন নাজমুল হাসান পাপনের কাছে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, মি. পাপন বলেন, “প্রধানমন্ত্রী যখনই ফোন দেবেন আমি ধরবোই”। গত বছর বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয়ের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ৫১ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে দলটির জন্য। বিসিবি গত সপ্তাহে এই অঙ্কের চেক নারী ফুটবল দলের হাতে তুলে দেয়। নাজমুল হাসান পাপন এ নিয়ে বলেন, “চেক অনেক আগেই রেডি ছিল, এটা নিতে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কেউই যোগাযোগ করেননি।” তিনি আরও বলেন, এই অল্প টাকার জন্য মেয়েরা একটা টুর্নামেন্টে যেতে পারেনি, এটা শুনে তিনি কষ্ট পেয়েছেন। “আমাদের ক্রিকেটারদের কাউকে বললেও ২০ লাখ টাকা ম্যানেজ হয়ে যেত,” বলেন ক্রিকেট বোর্ড প্রেসিডেন্ট।

সাফ জয়ের পর যে স্বপ্ন দেখেছিলেন নারী ফুটবলাররা, তা বেশিদিন টেকেনি
ছবির ক্যাপশান,সাফ জয়ের পর যে স্বপ্ন দেখেছিলেন নারী ফুটবলাররা, তা বেশিদিন টেকেনি

ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে চটিয়েছেন

ফুটবল ও ক্রিকেট বোর্ডের দুই কর্তাব্যক্তির বাদানুবাদের মাঝে যুক্ত হয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল।মিয়ানমারের অলিম্পিক বাছাই পর্বে বাংলাদেশের জাতীয় নারী ফুটবল দলকে কেন পাঠাতে পারেনি ফুটবল ফেডারেশন, তা জানতে চেয়েছে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, “অল্প কিছু টাকার জন্য ইচ্ছে করে অলিম্পিক বাছাইয়ে দল পাঠায়নি।”বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘বিস্তারিত’ বলবেন বলেও জানিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী।ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, মিয়ানমারে নারী ফুটবল দলকে পাঠানোর খরচ বাবদ অর্থ চেয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ২৭শে মার্চ ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু ২৯ তারিখই তারা বিবৃতি দেয় যে নারী দলটিকে তারা সফরে পাঠাতে পারছে না, এতে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বলছে এটা ‘বাফুফের অজুহাত’। এই অলিম্পিক বাছাইয়ে ভারত উত্তীর্ণ হয়েছে, বাংলাদেশেরও সুযোগ ছিল, এখন ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বলছে, ‘এটা মেয়েদের সাথে একরকম অন্যায়’। এর আগে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানিয়েছিলেন, “বাফুফের কাছে এখন মেয়েদের এই দলটিকে মিয়ানমার পাঠানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ নেই”। তিনি বলেন, বাফুফের খরচ বছরে কম করে হলেও ৬০ কোটি টাকা, কিন্তু রয়েছে ৩০ কোটির মতো। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল চলতি মাসের ২৪ তারিখ এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনস – এফসি বাছাইপর্বে খেলতে সিঙ্গাপুর যাবে, তবে তার খরচ আসবে এএফসির তহবিল থেকে। বাফুফে প্রেসিডেন্ট চলতি মাসের তিন তারিখ এই সংবাদ সম্মলনে বলেন, তিনি ভেবেছিলেন অলিম্পিক কমিটি বাছাইপর্বে সফরের খরচ ফাইনান্স করবে। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় মনে করছে, বাফুফে এই বিষয়টি নিয়ে অবহেলা করেছে এবং যখন আর কোনও সুযোগ নেই তখন তারা বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছে। এমন ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু কাজী সালাউদ্দিন একটি সংবাদ সম্মেলন করে মূলত চটিয়েছেন তিন পক্ষকে, যেখানে এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও হস্তক্ষেপ করবেন বলছে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।

নারী ফুটবলারদেরও চটিয়েছেন

বাংলাদেশের একজন নারী ফুটবলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলেন, সাফের পর আর তাদের বেতন দেয়া হয়নি। সাফের আগে ১০ হাজার টাকার মতো দেয়া হতো বলেন তিনি। বাফুফের একজন মুখপাত্র বলেন ভাষ্য, এই নারী ফুটবলারদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে বাফুফে তাই বেতন নিয়ে আলাদা করে ভাবা হয়নি। এই মিয়ানমার সফর যখন বাতিল হয়েছে ওই সময়ে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা একটা বিদ্রোহের ডাক দিয়ে তিনদিন অনুশীলন থেকে দূরে ছিলেন। বাফুফের কাছে নারী ফুটবলারদের পাঁচটি দাবি ছিল। যার মধ্যে বেতন ছিল প্রধান ইস্যু, এছাড়া বোনাস ও ম্যাচ ফি চেয়েছেন তারা এবং ক্যাম্পের খাবারের মান নিয়েও অভিযোগ করেন নারী ফুটবলাররা। তেসরা এপ্রিলের সেই আলোচিত প্রেস কনফারেন্সে কাজী সালাউদ্দিন বলেন, “অনুশীলন বন্ধ হলে তোমাদেরই ক্ষতি হবে।”

কাজী সালাউদ্দিন ‘মোটাদাগে ব্যর্থ’

সব মিলিয়েই নারী দলের মিয়ানমারে না যাওয়া নিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়িতে এখন কাজী সালাউদ্দিন একটা নেতিবাচক অবস্থানে আছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এই ঘটনাপ্রবাহে বাফুফে প্রেসিডেন্ট কাজী সালাউদ্দিনের কাছে মন্তব্যের জন্য ফোন দেয়া হলে তিনি তা ধরেননি, বাফুফের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, তারা এখন এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন না, “বিষয়টি আর খেলার মধ্যে নেই, এটা এখন রাজণৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে”।বাংলাদেশের সাবেক ফুটবলার রাশেদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কাজী সালাউদ্দিন যে সার্বিকভাবে ব্যর্থ হয়েছেন তা নয় কিন্তু তার ব্যর্থতাগুলো তার সফলতার চেয়ে অনেক গুরুতর।”তিনি উদাহরণ হিসেবে টানেন ২০০৯ সালের কোটি টাকার সুপার কাপকে, এই টুর্নামেন্টটি বাংলাদেশের ফুটবলে আবারও দর্শক ফিরিয়েছিল।কিন্তু বাফুফে এটা ধরে রাখতে পারেননি, নানা সময় ক্লাব ও পৃষ্ঠপোষকদের আস্থা হারিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবলের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা।শুধু তাই নয় বিদেশী কোচদের বেতন নিয়ে গড়িমসির খবরেও বাফুফে বিভিন্ন সময় এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন্স ও ফিফার ‘কারণ দর্শানো নোটিশ’ পেয়েছে।রাশেদুল ইসলাম বলেছেন, “সাফে খেলে ৫ থেকে ৮টি দল। এমন একটি টুর্নামেন্টেও টানা চার-পাঁচ আসরে বাংলাদেশ সেমিফাইনালও খেলতে পারেনি। এতে বোঝা যায় কাজী সালাউদ্দিনের আমলে বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবল দলটি কোন অবস্থায় আছে”।তবে তিনি যোগ করেছেন, এই সময়ে নারী ফুটবলে উল্লেখযোগ্য উন্নতি নিয়ে এসেছে বাফুফে।কিন্তু তাতে আসলে ফুটবলারদের জীবনে খুব বেশি পরিবর্তন আসছে না।বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বাংলাদেশের নারী ফুটবলে পেশাদারিত্ব নেই। পেশা হিসেবে তাই অনেকেই ফুটবল নিতে চাইবেন না”।বাস্তবতা অনেকটা এমনই, পেশাদারিত্বের অভাবে বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে অল্প বয়সে বিদায় জানিয়েছেন অনেকেই।অম্রাচিং মারমা – যিনি সাফ ফুটবলেও গোল করেছেন, ২৩ বছর বয়সে ফুটবল ছেড়েছেন।জয়া চাকমা – ২৮ বছর বয়সের এই সাবেক নারী ফুটবলার বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে রেফারির দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তিনি ফুটবল ছেড়েছেন ২০১২ সালে, অর্থাৎ মাত্র ২২ বছর বয়সে।

বাংলাদেশের সাবেক নারী ফুটবলার ডালিয়া আক্তার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন শুধুমাত্র বয়স-ভিত্তিক ফুটবল দল নিয়ে কাজ করেছে। নারীদের লিগ হওয়ার কথা থাকলেও তার কোনো ধারাবাহিকতা নেই।” সুত্রঃ বিবিসি বাংলা


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *