এশিয়ায় ভূরাজনীতির এক নতুন সূর্য উদিত হচ্ছে


মোহাম্মাদ সোলাইমান

জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে

ভারতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল—এ ধারণা সামনে ধরে জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এমন একটি কৌশলগত কাঠামো দাঁড় করিয়েছিলেন, যা বর্তমানে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশে বিস্তৃত হতে থাকা ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংহতির সূচনা করেছে।

দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে মিলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে একটি নতুন মহাদেশীয় ব্যবস্থা বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে বিনির্মাণ করতে পারে। ২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিনজো আবে প্রথমবারের মতো ভারত সফর করার সময় ভারতীয় পার্লামেন্টে ‘দুই সাগরের সংগম’ শিরোনামে ভাষণ দিয়েছিলেন।

১৬৫৫ সালে মোগল শাহজাদা দারাশিকোর লেখা একটি বই থেকে আবের ভাষণের এই শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল। ধর্মীয় ও সভ্যতাগত এমন অনেক ব্যাপার আছে, যা ইসলাম ধর্মাবলম্বী ও হিন্দুধর্মাবলম্বী উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান বলে বইটিতে বলা হয়েছে। আবে তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন, ঠিক একইভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এবং ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলও অনেক বিষয় ও মূল্যবোধ অভিন্নভাবে নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে। এই ‘স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির সাগরের’ ‘গতিশীল সংযোগ’ শুধু ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকেই বদলে দেবে না, বরং তা ‘এশিয়াকে বিস্তৃত করবে’।

তবে গত জুলাইয়ে গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হওয়া আবের চিন্তাচেতনায় শুধু নৌ সীমানা নয়, বরং আরও বেশি কি ছিল। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত ও জাপানের মধ্যে জোরালো একটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলা।

চীনের উত্থানের বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রভাবকে আমলে নেওয়া প্রথম এশীয় নেতা হিসেবে আবে নতুন শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টিতে নিজেকে ধর্মযোদ্ধার মতো নিয়োগ করেছিলেন। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক মাত্রা সম্প্রসারিত করে এবং এটিকে ভারত মহাসাগরের দিকে ঠেলে দিয়ে তিনি এই অঞ্চলের কৌশলগত প্রোফাইল পরিবর্তন করতে সহায়তা করেছিলেন।

২০০৭ সালের ভাষণে শিনজো আবে ওয়াশিংটনের তৎকালীন বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। যখন যুক্তরাষ্ট্র তার দুর্ভাগ্যবাহী ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ শিখরে অবস্থান করছিল এবং ইরাক ও আফগান যুদ্ধ নিয়ে তুমুল ব্যস্ত ছিল; ঠিক তখন ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাসূচক চীনকেন্দ্রিক ‘অভিন্ন গন্তব্যের সম্প্রদায়’ সংজ্ঞাকে শিনজো আবে পুনঃসংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছিলেন।

আবে ও তাঁর উত্তরসূরিদের জন্য প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য সম্পর্কের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইউরেশীয় ও আফ্রিকান এলাকাজুড়ে সহযোগিতা বাড়ানোই ছিল বৃহত্তর এশিয়া গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের মূল চাবিকাঠি। বৃহত্তর ও বিস্তৃত এশিয়ার যে স্বপ্ন, তার মাঝখানে ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে স্থাপন করে আবে ও তাঁর উত্তরসূরিরা মূলত ঊনবিংশ শতকের আমেরিকান অ্যাডমিরাল আলফ্রেড মাহান এবং ব্রিটিশ নৌ ইতিহাসবিদ জুলিয়ান করবেটের অন্তর্দৃষ্টিরই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

আধুনিক নৌ কৌশলের দুই অগ্রদূত মাহান ও করবেট নৌ শক্তিকে জাতীয় শক্তির জরুরি উৎস বলে মনে করতেন। বিংশ শতকের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যালফোর্ড ম্যাককিন্ডার ইউরেশীয় কেন্দ্রস্থলের (ইউরেশিয়ান হার্টল্যান্ড) ওপর নজর কেন্দ্রীভূত করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই শতাব্দীরই আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিকোলাস স্পাইকম্যান তাঁর বিপরীতে গিয়ে ইউরেশিয়ান রিমল্যান্ডের (রাজনৈতিক অথবা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড) ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার ওপর জোর দিয়েছেন।

সমুদ্রশক্তির ওপর মাহান ও করবেট—দুজনেরই লেখা এবং ভূরাজনীতিতে স্পাইকম্যানের সমুদ্রসীমাভিত্তিক পদ্ধতি শিনজো আবের বিস্তৃত এশিয়ার ধারণার ভিত্তি গড়েছিল। আজ শিনজো আবের ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের স্পষ্টতম প্রকাশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান—এই চার দেশের সংগঠন কোয়াড (কোয়াডরিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ)। ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ভয়ানক সুনামি আঘাত হানার পর মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কোয়াডের জন্ম হলেও ২০১৭ সালে আবের উদ্যোগে সংগঠনটিকে একটি ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন করে বিনির্মাণ করা হয়েছিল।

কিন্তু কোয়াড ছিল মূল যাত্রার শুরু মাত্র। এর ধারাবাহিকতায় একের পর এক সংগঠনের উৎপত্তি হয়েছে। এই অঞ্চলের ভূকৌশল সামনে রেখে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য গঠন করে ‘অকাস’। যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া-জাপান মিলে গঠন করে ত্রিপক্ষীয় কৌশলগত সংলাপ। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া-ইন্দোনেশিয়া-ভারত মিলে আরেকটি জোট গঠিত হয়। এই সব গুলো জোট গঠনের উদ্দেশ্য ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।

ইরাক যুদ্ধ এবং আরব বসন্তের পর আরব দেশগুলো নিজেদের কৌশল ও কূটনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে বাধ্য হয়। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা অন্য দেশগুলোর ওপর থেকে তাদের নির্ভরতা কমিয়ে ফেলে। ঠিক সেই সুযোগে চীন, জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশীয় দেশ সেই শূন্যতা পূরণে আরব দেশগুলোর দিকে এগিয়ে যায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব খুব দ্রুতই ভারতের যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হয়ে ওঠে। জাপান ইতিমধ্যে প্রযুক্তি, কার্বনমুক্ত জ্বালানি ও মহাশূন্য গবেষণা খাতে এই অঞ্চলে আস্থাশীল দেশ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে উপসাগরীয় দেশগুলো এবং মিসরে প্রযুক্তি ও অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে দক্ষিণ কোরিয়া।

প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য সম্পর্ক গভীর করার মাধ্যমে উপসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এশিয়ার অর্থনৈতিক বলয়ে ঢুকে পড়েছে। শিনজো আবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিতে ভারসাম্য আনতে চেয়েছিলেন, আর কৌশলবিদ এবং বুদ্ধিজীবীরা (আমিসহ) ভারত এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ক্ষমতার আঞ্চলিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।

ইন্দো-প্যাসিফিক এবং পশ্চিম এশিয়ার ইন্দো-আব্রাহামিক দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ হিসেবে ভারত কাজ করছে। এর মধ্য দিয়ে এশিয়াভিত্তিক একটি মহাদেশীয় ব্যবস্থা আদল নিতে শুরু করেছে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • মোহাম্মাদ সোলাইমান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের স্ট্র্যাটেজিক টেকনোলজি অ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *