উন্নয়নের ১৪ বছর
বন্ধু মাহবুবের পোষ্ট থেকেঃ
বর্তমান সরকারের প্রায় চোদ্দ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে অসংখ্য উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে তা দৃশ্যমান। মানুষ তার সুফলও ভোগ করছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
পদ্মা ব্রীজ হয়েছে। তাতে রেললাইনও সংযুক্ত করা হয়েছে। পুরো উত্তরাঞ্চল সড়ক ও রেলপথে মুল ভুখন্ডের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশ কিছু ফ্লাইওভার হয়েছে। ঢাকায় মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেস ওয়ে হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল হয়েছে। ঢাকা চিটাগং হাইওয়ে চার লেন হয়েছে। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। একাধিক কয়লা ও পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়েও বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও চাহিদার চেয়ে বেশী বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে দাবি সরকার করছে তা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়না। কারণ শহরের বাইরে লোডশেডিং হচ্ছে। সঞ্চালন লাইনের সক্ষমতার অভাবের কারণে এমনটা হচ্ছে সরকারের এ দাবীও পুরোপুরি সঠিক নয়। তেমনটা হলে গত কয়েক বছরে সরকার এ সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারতো। আশা করা যায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলো চালু হলে মফস্বলে লোডশেডিং কমে আসবে।
উপরোল্লিখিত উন্নয়ন কার্যক্রম দেশীয় অর্থায়নে সম্ভব নয় তা সবাই জানে। এই কাজগুলো করতে প্রচুর বৈদেশিক ঋণ নিতে হয়েছে। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এত বিশাল অংকের ঋণ নিয়ে অবকাঠামোর দ্রুত উন্নয়ন ঘটানোর সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে কিনা? বর্তমানে সব মিলিয়ে আমাদের অর্থনীতি কেমন আছে? একটা ডায়াগনসিস করলেই সবাই সঠিক চিত্রটি বুঝতে পারবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান আসে মূলত দু’টি সেক্টর থেকে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। চলুন দেখি চোদ্দ বছরে এই দুই খাত কেমন করেছে।
২০০৯ সালে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল (১৫.৫) বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে (৫৪.৬৯) বিলিয়ন ডলারে। তারমানে চোদ্দ বছরে রপ্তানি বেড়েছে (৩৯.১৯) বিলিয়ন ডলার।
২০০৯ সালে রেমিট্যান্স এসেছে (৯.৬৮) বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে তা এসে দাড়িয়েছে (২১.০৩১) বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এ খাতে মোট (১১.৩৫১) বিলিয়ন ডলার আয় বেড়েছে। সুতরাং রপ্তানি + রেমিট্যান্স থেকে মোট আয় বেড়েছে চোদ্দ বছরে (৩৯.১৯+১১.৩৫১) = ৫০.৫৪১ বিলিয়ন ডলার।
এবার দেখি ব্যয় কেমন বাড়লো? ২০০৯ সালে আমদানি ব্যয় মেটাতে খরচ হয়েছে (২৩.২) বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে ব্যয় হয়েছে (৮৮.২৩) বিলিয়ন ডলার। তারমানে চোদ্দ বছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে (৬৫.০৩) বিলিয়ন ডলার।
এবার যদি আয় ব্যয়ের হিসেব কষি –
২০০৯ সালে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে মোট আয় (১৫.৫+৯.৬৮ = ২৫.১৮) বিলিয়ন ডলার। আমদানি খাতে ব্যয় (২৩.২) বিলিয়ন ডলার মাইনাস করলে দাঁড়ায় (২৫.১৮-২৩.২ = ১.৯৮) বিলিয়ন ডলার (উদ্ধৃত্ত)।
২০২২ সালে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে মোট আয় (৫৪.৬৯+২১.০৩১ = ৭৫.৭২১) বিলিয়ন ডলার। আমদানি খাতে ব্যয় (৮৮.২৩) বিলিয়ন ডলার মাইনাস করলে দাঁড়ায় ((৭৫.৭২১-৮৮.২৩ = ( – ১২.৫০৯)) বিলিয়ন ডলার ঘাটতি।
অর্থাৎ ২০০৯ সালে রপ্তানি ব্যয় মিটিয়ে বাংলাদেশের প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার সঞ্চয় হতো। ২০২২ সালে এসে প্রায় সাড়ে বার বিলিয়ন ডলার ঘাটতি তে আছে।
এই ঘাটতি কিভাবে মেটানো হচ্ছে? সোজা হিসেব। ঋণ করে।
এবার দেখি বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋনের ব্যাবস্থাপনা কেমন চলছে?
২০০৯ সালে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল (২৫.৩৭) বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে তা এসে দাড়িয়েছে (৯৬.২) বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ চোদ্দ বছরে ঋণের পরিমাণ ((২৫.৩৭-৯৬.২ = (-৭০.৮৩)) বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছে (২.৭২) বিলিয়ন ডলার। যা ২০০২১-২২ অর্থবছরে ছিল (২.০১) বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের কিস্তি (৭৩০) মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র এক বছরে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশকে (৩.২৮) বিলিয়ন ডলার কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এবং ২০২৯ -৩০ অর্থবছরে কিস্তির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে (৫.১৫) বিলিয়ন ডলার। যদি এর মধ্যে আরও ঋণ না নেয়া হয়। যা অসম্ভব কারণ ঘাটতি তে থাকা অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ করতেই হবে। তাই ঋণের কিস্তি বাড়বে। তা পরিশোধ করতে আরও বৃহৎ ঋণের প্রয়োজন পড়বে। এটিকে একটি চক্র বলতে পারেন। তাই চাইনিজ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে বাংলাদেশকে এখন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।
রাজনীতিবিদরা ফলাও করে দেশের মানুষের কাছে যে বিষয়টি বেশী প্রচার করেন তা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০০৮-৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল (৭.৪৭) বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে এসে তা দাড়িয়েছে (৩২.৯৪) বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ রিজার্ভ বেড়েছে (৩২.৯৪-৭.৪৭ = ২৫.৪৭) বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে (৭০.৮৩) বিলিয়ন ডলার। (৭০.৮৩-২৫.৪৭ = ৪৫.৩৬) এটা শ্রেফ শুভংকরের ফাকি। কইয়ের তেল দিয়ে কই ভাজা। অন্যের টাকায় রিজার্ভ বাড়িয়ে দেখানো। জনগণকে সোজা কথায় প্রতারিত করা।
এই সরকারের আমলে বিশাল আকারের দূর্ণীতি হয়েছে তা সবাই বোঝে। কিন্তু কি প্রক্রিয়ায় তারা দূর্ণীতি টা করেছে তা কেউ সহজ ভাষায় ব্যাক্ষা করছেনা।
আসলে এরা দূর্ণীতিটা করেছে আমদানী ব্যয়ের নামে।
বাংলাদেশের রপ্তানির সিংহভাগ আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে। বর্তমানে নিটিং ডায়িং এমনকি এক্সেসরিজও দেশেই উৎপাদিত হয়। তাই রপ্তানি বাড়লে তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমদানি ব্যয় এমনভাবে বাড়ার কথা না। মেশিনারিজ আমদানি বাবত ব্যয় হয়। কিন্তু এমন বিশাল অংকের ব্যয় হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ব্যাবসায়ীরা যা আয় করে তারচেয়ে বেশী মেশিনারিজ ক্রয় করবেনা।
উন্নয়ন প্রজেক্ট গুলোর ব্যয় কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আমদানি ব্যয়ের ওভার ইনভয়েসিং-এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাচার করে দেয়া হয়েছে। চোদ্দ বছরে কমপক্ষে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে আমার ধারণা। যার সিংহভাগই পশ্চিমা বিশ্বে পাচার হয়েছে। সাম্প্রতিক সম্পর্ক অবনতির কারণে এর একটি বড় অংশ সিংগাপুরের ব্যাংক গুলোতে ট্রান্সফার করা হয়েছে। যার বেশীরভাগই চাইনিজ মালিকানাধীন। চাইনিজ ঋণের টাকায় যে উন্নয়ন কার্যক্রম গুলো হয়েছে তার বেশীরভাগই চাইনিজ কন্সট্রাকশন কোম্পানি গুলো করেছে। সেই বাবদ ঋণের টাকার একটি বিশাল অংশ তাদের দেশে অলরেডি ফেরত গেছে। এবার পাচার করা অর্থও তাদের মালিকানাধীন ব্যাংকে জমা পড়েছে। বছর বছর ঋণের কিস্তিও জমা পড়ছে। চাইনিজরা বিভিন্ন দেশে তাদের পক্ষের গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়ে ঐ দেশের সম্পদ লুটের এই ফাঁদ পেতে বসেছে। ঋণের অর্থ পাচার হয়ে তাদের ব্যাংকেই জমা পড়বে। মাঝখানে দেশগুলোর জনগণের গলায় তাদের ঋণের জাল ফাঁস হয়ে পেচিয়ে ধরবে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ নেই তা নয়। অবশ্যই রয়েছে। আমদানি ব্যয় কমাতে হবে। আয় ব্যায়ের ঘাটতি কমিয়ে অর্থনীতিকে উদ্ধৃত্তিতে নিয়ে আসতে হবে। যদি তা সম্ভবও হয় বর্তমান ঋণ পরিশোধ হতে ২০৬২ সাল লেগে যাবে। এ কাজ করতে প্রয়োজন সৎ নেতৃত্ব। আর যদি এখন যেভাবে চলছে বা যারা চালাচ্ছে কন্টিনিউ করে তাহলে ঋণের কিস্তি বৃহত থেকে বৃহত্তর হবে। ডলারের অপ্রতুলতার কারণে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে ট্যাক্স বাড়াতে হবে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিতে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে। ঋণ নেয়ার বিনিময়ে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে হবে ভিন্ন দেশের কাছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির পজিটিভ দিক হচ্ছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আশানুরূপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধীরে ধীরে তা আরও বাড়বে। উন্নয়ন প্রজেক্ট গুলোর ব্যয় বৃদ্ধি ঠেকানো গেলে এবং আমদানিকৃত পণ্যের ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে পাচার রোধ করা গেলে অর্থনীতি কয়েক বছরের মধ্যেই বিদেশী ঋণ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসবে।