ইতিহাসের আতঙ্কিত অধ্যায়


( দ্বিতীয় পর্ব)

মোর্শেদুল আমিন শাহীন

লেখক : মোর্শেদুল আমিন শাহীন

মার্কিনীদের হাতে কিংবা সিআইএ’র কূটকৌশলে যে সব নেতারা নিহত হয়েছেন তাঁদের কিছু তুলে ধরলাম।

গাদ্দাফি –

উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার ৪২ বছর শাসন ক্ষমতাধর মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিহত হয়েছিলেন ন্যাটো সমর্থনপুষ্ট বিরোধী গোষ্ঠীর হাতে । ২০১১ সালের আগস্টে এনটিসি বাহিনীর হাতে ত্রিপোলির পতনের পর, গাদ্দাফি এবং তার পরিবার লিবিয়ার রাজধানী থেকে পালিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন বলে ব্যাপক গুঞ্জন ছিল। প্রকৃতপক্ষে ত্রিপোলির পতনের দিন গাদ্দাফি সির্তে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

এটা স্পষ্ট নয় যে বিরোধী বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার আগে সেখানে ন্যাটোর ভূমিকা কী ছিল। তবে তাদের বিবৃতি অনুযায়ী, বিমান হামলার সময় ন্যাটো অবগত ছিল না যে গাদ্দাফি ওই গাড়িবহরে আছেন। এদিকে গাদ্দাফি নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার পরপরই ফক্স নিউজের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গাদ্দাফিবিরোধী চূড়ান্ত অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোনও অংশ নিয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি মার্কিন শিকারি ড্রোন গাদ্দাফির মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তার কনভয়ে হামলায় জড়িত ছিল। পরে নাম প্রকাশ না করে এক মার্কিন কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে বর্ণনা করেছিলেন ‘পেছন থেকে নেতৃত্ব দেওয়া’ হিসেবে।

সাদ্দাম হোসেন

নাইন-ইলেভেনের পর আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে ধরতে আফগানিস্তানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর কিছুদিন পর ২০০৩ সালে মার্কিন হামলা শুরু হয় ইরাকে। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরাকে ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত করেছেন দাবি করে ওই হামলা চালানো হয়। যদিও ওয়াশিংটনের এই দাবির সত্যতা মেলেনি।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০৩ সালের ১৭ মার্চ সাদ্দামকে ক্ষমতা ছাড়তে বলেন এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইরাক ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। তা ন- হলে ইরাককে যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি। এ ছাড়া সাদ্দাম দেশ ছেড়ে গেলেও, নতুন সরকারকে স্থিতিশীল করতে এবং গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সন্ধানে মার্কিন বাহিনীর প্রয়োজন হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন বুশ।

এ ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদকারী যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা-সিআইয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন, মূলত নাইন-ইলেভেনের পরই ইরাকি প্রেসিডেন্টকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওয়াশিংটন।

কাসেম সোলাইমানি

২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে জেনারেল সোলাইমানিকে বহনকারী গাড়ির ওপর ড্রোন হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করে মার্কিন সেনারা। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি সিআইএ ও মোসাদের হিট লিস্টে ছিল।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীতে যেকজন ব্যক্তির গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম মার্টিন লুথার কিং। জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টায়। প্রথমে তার নাম রাখা হয় মাইকেল কিং জুনিয়র। পরে বিখ্যাত জার্মান সংস্কারক মার্টিন লুথারের নামানুসারে তার নাম রাখা হয় মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।

সারা জীবন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া কিংবদন্তি এই নেতার নেতৃত্বেই যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গরা পেয়েছে শ্বেতাঙ্গদের সমান অধিকার। নাগরিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন মার্টিন লুথার কিং। নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ।

১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মন্টোগমারীতে বাস ধর্মঘট কিংবা ১৯৬৩ সালের ফ্রিডম মার্চ, ঐতিহাসিক এমন অনেক আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং। কিন্তু অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে অকালেই পৃথিবী ছাড়তে হয় তাকে। ১৯৬৮ সালের ৩ এপ্রিল হত্যার হুমকি পান তিনি। এ সময় তাকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে সকলকে হিংসা ত্যাগের আহ্বান জানান অকুতোভয় লুথার কিং। পরদিন অর্থাৎ ৪ এপ্রিল একটি ধর্মঘটে সমর্থন দিতে মেমফিসে যান তিনি। ওঠেন লরেইন নামের একটি হোটেলে। সেদিন সন্ধ্যায় ওই হোটেলেই আততায়ীর গুলিতে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে নিহত হন লুথার কিং।

কথিত আছে মার্টিন লুথার কিং মার্কিনিদের এবং সিআইয়ের রোষানলে পড়েছিলেন ।

ফিদেল কাস্ত্রো

শুধু হত্যা নয় একাধিক হত্যাচেষ্টার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের নাম। এর মধ্যে ঘুরেফিরে যাদের নাম আসে, তাদের মধ্যে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন, কঙ্গোর সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান প্যাট্রিক লুমুম্বা, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রাফায়েল ট্রুজিলো, তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট জিও দিন দিয়েম, চিলি সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডার-ইন-চিফ রেনে স্নাইডার অন্যতম।

তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ফিদেল কাস্ত্রো। তার নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফেবিয়ান এসকালান্তের মতে, ১৯৫৯ সালে কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর চুরুটে বিস্ফোরক গুঁজে দেওয়া, ডাইভিং স্যুটে বিষ মাখিয়ে দেওয়ার মতো অভিনব নানা পন্থায় কাস্ত্রোকে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। এর মধ্যে কাস্ত্রোকে ৮ বার হত্যাচেষ্টার কথা স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেও। ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর ৯০ বছর বয়সে হাভানায় মারা যান কিউবার সমাজতান্ত্রিক এই নেতা।

ইতিহাস বলে, এযাবৎকালে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গুপ্তহত্যা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ । আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসেব নিকেশে সবচেয়ে বেশি গুপ্ত হত্যা, রাজনৈতিক হত্যা, নিজেদের ভালো না লাগলে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের রাষ্ট্র নায়কদের থেকে শুরু করে নাতিপাতি আমজনতাকে শায়েস্তা করার চৌকশ বাহিনি সিআইএ। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন এই সংস্থাটির চোখ ফাঁকি দেওয়া প্রায় অসম্ভব। আর যেকোনো গুপ্তহত্যায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় হলে সেখানে সব সময় নেপথ্যে থাকে এই সংস্থাটি। এ ছাড়া পলিটিক্যাল বা টার্গেটেড কিলিং-এর জন্য বিশ্বব্যাপী হিটম্যান বা ভাড়াটে খুনি নিয়োগেরও অভিযোগ রয়েছে সিআইএর বিরুদ্ধে।

দফায় দফায় মার্কিনিদের দুয়ারে ধর্নাধরা পিছনে বিশাল এক জুজুর ভয় কাজ করে আমাদের দেশের সকল রাজনৈতিক নেতাফেতাদের।

লেখক : মোর্শেদুল আমিন শাহীন
লেখক ও অনলাইন এক্টিভিটস


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *