ইতিহাসের আতঙ্কিত অধ্যায়।


মোর্শেদুল আমিন শাহিন

মোর্শেদুল আমিন শাহিনঃ

“উদয়াস্ত দুই তটে অবিচ্ছিন্ন আসন তোমার,
নিগূঢ় সুন্দর অন্ধকার।
প্রভাত-আলোকচ্ছটা শুভ্র তব আদিশঙ্খধ্বনি”

রবীন্দ্রনাথের অন্ধকার কবিতাটির সাথে আজকের লেখাটির তেমন কোন সাদৃশ্য নেই। ইচ্ছে হল তাই লিখলাম।

কয়দিন ধরে খুব ভয় হচ্ছে। দেশের রাজনীতিতে আবার কি কোন অশনি বার্তা অপেক্ষা করছে ! গত ৫০-৬০ বছরের ইতিহাস একটু করে দেখে আসি।

বর্তমানের মার্কিনিদের হামকিধামকি দেখে ইতিহাসের ষাটের দশকের চেহারা সিনেমার মতো ভেসে আসছে।

ষাটের দশকে গণমানুষের মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, চিলির আল সালভাদর আলেন্দে, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা।

তাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাম্রাজ্যবাদের সকল বাধা অতিক্রম করে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি জাতি-রাষ্ট্র। এই নতুন রাষ্ট্রটি এগিয়ে যাচ্ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার পথে। অপরদিকে সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা অর্থনীতির ধারক আমেরিকার নাকের ডগায় বসে দক্ষিণ আমেরিকায় সমাজতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল চিলির প্রেসিডেন্ট আল সালভাদর আলেন্দে। এই দুই জাতীয়তাবাদী নেতাই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হয়ে প্রাণের বিনিময়ে তাঁদের জাতির কাছে অমর হয়ে রইলেন।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপনীয় দলিলপত্র আলেন্দে যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারেন সেজন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ১৯৬২-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ৩০ লাখ মার্কিন ডলার খরচ করেছে। আলেন্দের বিরোধী প্রার্থী এডওয়ার্ড কেরির পক্ষে খরচ করেছে প্রায় ২৫ লাখ মার্কিন ডলার। স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭০ সালে সিআইএকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আলেন্দে প্রশাসন কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না।

গবেষকরা মনে করেন, প্রেসিডেন্টের মনোবাসনা পূরণ করতে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার এবং সিআইএর কর্মকর্তারা ট্রেক-১ এবং ট্রেক-২ নামে দুইটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। ট্রেক-১ পরিকল্পনা অনুযায়ী তথাকথিত সংসদীয় ট্রিকারির (ঞৎরশধৎু) মাধ্যমে অভ্যুত্থান এবং ট্রেক-২ অনুযায়ী চিলির সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ট্রেক-১-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী আলেন্দেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভোটে পরাজিত করে ক্ষমতায় আরোহণের পথ বন্ধ করা যায়নি। ট্রেক-২ অনুযায়ী চিলির সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়েছে।

চিলির আলেন্দের মতোই বাঙালী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে শহীদ হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে কতিপয় নরপিশাচ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর দলেরই বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক খুনীদের হাত ধরে অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় সারাবিশ্বে যে দুজন বিদেশি আনন্দিত হয়েছিলেন, উল্লাসিত হয়েছিলেন তাদেরে প্রথম জন কিসিঞ্জার , দ্বিতীয় জন পাকি ভুট্টো।

বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মোশতাকের অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘাতক সরকারকে সবার আগে স্বীকৃতি দেয় ভুট্টো। আর মুজিব হত্যার ৫ দিনের মাথায় ২০ আগস্ট খুনি মোশতাককে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

প্রতিহিংসাপরায়ণ কিসিঞ্জার এতটাই উল্লসিত হন যে, তিনি বলেন- “মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পেরে আমরা নিজেকে ধন্য মনে করছি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তান এবং তাদের দোসরদের উপেক্ষা করে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে নিজের দেশকে স্বাধীন করে ১৯৭১ সালেই মুজিব বিশ্ব নেতায় পরিণত হন।

১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের কাছে শুধু পাকিস্তান পরাজিত হয়নি, খোদ যুক্তরাষ্ট্রই পরাজিত হয়েছিল। একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণের কয়েক ঘণ্টা আগে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা ফারল্যান্ড ৩২ নম্বর বাসভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন।

ফারল্যান্ড আমেরিকার পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, ‘পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক এটা তারা চান না।’ কিন্তু মার্কিন হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে শেখ মুজিব তার ৭ মার্চের ভাষণে প্রকারান্তরে দেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করেন।

কিসিঞ্জার একাত্তরের লজ্জাজনক পরাজয়ের কথা ভুলতে পারেননি।

২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে লিফশুলজ বলেন, “আমার অভিমত, জিয়া তার ব্যক্তিগত কারণেই ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেননি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এটি ছিল তারই এজেন্ডা, যা তিনি ও অন্য কিছু অফিসার জানতেন। কেননা আমি বিশ্বাস করি, জিয়ার সুস্পষ্ট সমর্থন ছাড়া মুজিব হত্যাকাণ্ড- সফল হতো না, এমনকি তারা এগুতেই সাহস পেতো না। তাইতো জিয়াই এই হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ ‘ছায়া মানুষ’।”

এমন হাজারো তথ্য ওঠে এসেছে মার্কিন অবমুক্ত করা দলিলে।

ব্যুরো পরিচালক উইলিয়াম জি হিল্যান্ড কিসিঞ্জারকে জানান, ‘আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলেছি, তখনও তিনি (শেখ মুজিব) নিহত হননি।’ কিসিঞ্জার প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা? তারা কি কিছু সময় পর তাকে হত্যা করেছে?’ এর জবাবে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন বলেন, “আমরা যতদূর জানি- আমি বলতে পারি না যে, আমরা বিস্তারিত সবকিছু জেনে গেছি। কিন্তু ইঙ্গিত ছিল তাকে হত্যা-পরিকল্পনা বিষয়েই। তারা তার বাড়ি ঘিরে ফেলে। ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাকে হত্যা করে।” ওয়াশিংটন সময় সকাল আটটায় বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে স্টাফ সভায় মিলিত হওয়া এবং তারও আগে মুজিব হত্যা সম্পর্কে আথারটনের সঙ্গে কিসিঞ্জিারের তৎপরতা থেকে বোঝা গেল যে, ওই রাতে কিসিঞ্জার ঘুমাননি।

যদ্দূর জানা যায়, ১৯৭৫ সালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ইউজিন বোস্টার মুজিব হত্যা-ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ছিলেন। আর বাংলাদেশে মোশতাক, জিয়া, ফারুক-রশীদ চক্র তাদের বিদেশি প্রভুদের ভৃত্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।

মিজানুর রহমান খান লিখেছেন: প্রাপ্ত মার্কিন নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, “জেনারেল জিয়াউর রহমান সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসনকে একান্ত আপন মনে করেছিলেন। ৭ নভেম্বর জিয়া ক্ষমতা নিয়েই তার দূতকে বোস্টারের কাছে পাঠান। ব্যক্তিগত শুভেচ্ছার জবাবে বোস্টার এ সময় জিয়াকে পুরনো বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন। বার্তাটি ছিল এরকম: ‘বাংলাদেশটা পাকিস্তানপন্থী, ইসলামপন্থী ও পাশ্চাত্যপন্থী হয়ে গেছে।

ভারত এখন বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। এটা ঠেকাতে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চাই।’ ১৯৭৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ৮১ দিনের মাথায় ক্ষমতা নিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রথম বার্তা।” ( দৈনিক প্রথম আলো, ১৬.৮.২০০৯ )।

অবমুক্ত দলিল অনুযায়ী ২ নভেম্বর মধ্য রাতে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের সময় মোশতাকসহ ফারুক রশীদ চক্র সূর্যাস্তের আগেই পালাতে চেয়েছিল। মোশতাক গং মার্কিন হেলিকপ্টারে চড়েই যুক্তরাষ্ট্রে পালাতে আবদার করেছিলেন। কিন্তু বিমান দিতে রাজি না হলেও খুনিদের আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ৫ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের বোস্টারের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় (২৬১৭৮৫) নির্দেশনা দেন- “আপনি রাষ্ট্রপতি মোশতাককে অব্যাহতভাবে এই নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন রয়েছে। আপনি মোশতাককে এটা জানিয়ে দিতে পারেন- তিনি যদি আসতে চান তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে স্বাগত জানাবে। তাকে এটাও জানাতে পারেন, যদি তিনি মনে করেন তার জীবনের নিরাপত্তাজনিত হুমকি অত্যাসন্ন, তাহলে অস্থায়ীভাবে দূতাবাসে আশ্রয় দিতে আমরা প্রস্তুত থাকবো।” ( দৈনিক প্রথম আলো, ১৩.৮.০৯ )।

পর্যবেক্ষক মহলের মতে, সুপরিকল্পিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই মুজিব হত্যার ৮১ দিনের মাথায় ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন আগস্ট চক্রান্তের প্রধান হোতা- জিয়াউর রহমান। এরপর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে ’৮১ সালের ৩০ মে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাখেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর লক্ষ্য নিয়েই ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়। কিসিঞ্জার-ভুট্টো-সৌদি-চীন চক্র স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনি।

ড. কিসিঞ্জারের প্রাক্তন স্টাফ এসিসট্যান্ট রজার মরিস এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবের প্রতি কিসিঞ্জারের তীব্র ঘৃণার কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানিয়েছেন- “কিসিঞ্জারের বিদেশি শত্রুর তালিকায় তিনজন সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হচ্ছেন আলেন্দে, থিউ ও মুজিব।” মরিস বলেন, “মুজিব ক্ষমতায় আসেন সব কিছু অগ্রাহ্য করে। আমেরিকা ও তার অনুগ্রহভাজন পাকিস্তানকে সত্যিকারভাবে পরাজিত করে এবং মুজিবের বিজয় ছিল আমেরিকার শাসকবর্গের পক্ষে অত্যন্ত বিব্রতকর।” (দি আনফিনিশড রেভিল্যুশন, লরেন্স লিফশুলজ, পৃষ্ঠা ১৩৭-১৩৮)। সর্বশেষ মার্কিন অবমুক্ত দলিলেও প্রমাণিত হলো পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কারণেই শেখ মুজিব ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আর এই হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হচ্ছেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জার।

(দুই পর্বের প্রথম অংশ )

( তথ্য সুত্র – বিভিন্ন ইতিহাসের বই )
মোর্শেদুল আমিন শাহিন
লেখক ও অনলাইন এক্টিভিটস


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *