যাঁর নামে ঢাকার বদরুন্নেছা কলেজ

এম,এ হক
১৯৪৪ সালে, সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা ডুমুরগ্রাম সিউড়ি কলকাতার নূরীকে প্রথম দেখেন, কুষ্টিয়ার আমলাপাড়ার ৩২ নম্বর এন.এস.রোডের নুরউদ্দিন। প্রথম দেখা শিলিগুড়ি শহরে। নুরউদ্দিন তখন বনবিভাগের অফিসার, চাকরীর প্রথম পোস্টিং শিলিগুড়ি শহরের অদূরে বাগডোগরাতে।
প্রথম দেখাতে কলকাতা শহরের আধুনিক স্মার্ট চটপটে নূরীকে ভাল লাগে নুরউদ্দিনের। এই ভাললাগা আরো বৃদ্ধি পায়, যখন শিলিগুড়ি শহরের নূরীকে নিয়ে দুর্গাপুজা দেখতে বের হন নুরউদ্দিন। সেদিন শিলিগুড়ি শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর বুকে শরীর বিলিয়ে দিয়েছিল জ্যোৎস্না। আর নূরী ও নুরউদ্দিন তখন হারিয়ে যান গল্পের ভূবনে।
নূরী বেশ কিছুদিন ছিলেন শিলিগুড়িতে। নূরীর সাথে গল্প করার লোভ সামলাতে না পেরে হুটহাট করে নুরউদ্দিন মাঝে মাঝেই হাজির হতেন নূরীর আবাসস্থলে।
একদিন হঠাৎই নূরী চলে যায় কলকাতা। কিন্তু বাগডোগরার নুরউদ্দিনকে সে ভুলতে পারে না। চিঠি আদান প্রদানের মাঝে কখন যে মন আদান প্রদান হয়ে যাবে,কে জানত?
১৯৪৭ সালের ২৩ জুলাই দুইজনের হাত আদান প্রদান হয়। কলকাতার ভিটামাটি ছেড়ে নূরী পাড়ি জমান এপার বাংলাতে। যশোর, খুলনা আর চট্টগ্রাম পার হয়ে ১৯৫২ সালে নুরউদ্দিনের পোস্টিং হয় সিলেট। নূরী ততদিনে একাধিক সন্তানের জননী। ১৯৫৩ সালে সিলেটের এম.সি কলেজ থেকে মানবিকে স্নাতক পাশ করেন নূরী। তখনো কেউ বুঝে উঠেনি এই নূরী থেকেই সিলেটের মাটিতেই জন্ম নেবে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম নারী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব “বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ”। স্বামী নুরউদ্দিন আহমেদ তাকে “নূরী” নামেই ডাকতেন ।
বেগম বদরুন্নেসা আহমদের লেখাপড়ার সূচনা বেগম রোকেয়ার হাতে গড়া “সাখাওয়াত মেমোরিয়াল মুসলিম গার্লস স্কুলে”। হয়ত সরাসরি দেখেওছিলেন তিনি বেগম রোকেয়াকে। ১৯৪২ সালে সেই স্কুল থেকেই তিনি পাশ করেন ম্যাট্রিকুলেশন। ১৯২৪ সালের ৩ রা মার্চ জন্ম নেওয়া বদরুন্নেসার বয়স তখন ১৮।
১৯৪৪ সালে তৎকালীন কলকাতার বিখ্যাত “লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ” থেকে পাশ করেন ইন্টারমিডিয়েট। এম.সি. কলেজের পাঠ চুকিয়ে ১৯৬১ ও ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন যথাক্রমে মাস্টার্স ইন এডুকেশন ও মাস্টার্স ইন পলিটিক্যাল সাইন্স ডিগ্রী। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন বাংলার মহা দুর্ভিক্ষের সময় বেগম বদরুন্নেসা আহমদ ভলেন্টিয়ার সার্ভিসে অংশগ্রহণ করেন। দুর্ভিক্ষ পিরীতদের জন্য তিনি রান্না-বান্নার কাজে সাহায্য করতেন।
১৯৫২ সালে তিনি সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রী থাকা অবস্থাতে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে, উত্তপ্ত সিলেট শহরের বিভিন্ন মিছিল ও পদযাত্রায় শরিক হতে থাকেন। সে সময়কার অল পাকিস্থান উইমেন্স এসোসিয়েশনের সদস্য হিসাবে বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজে অংশগ্রহনের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পান “কুইন এলিজাবেথ কারনেশন মেডেল”। মিষ্ট ভাষী বদরুন্নেসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো ধীরে ধীরে। সমসাময়িক যে প্রাদেশিক আইনসভার তোরজোড় চলছিল, সেইবার নারীদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ আসায়- স্বামী নুরউদ্দিন আহমেদের মনে হয়, বদরুন্নেসা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষমতা রাখেন। বেগম বদরুন্নেসাকে সেটা জানাতেই বেগম বদরুন্নেসা নিজেও আগ্রহ প্রকাশ করেন। কুষ্টিয়া ও ঢাকার নিকটজনের পরামর্শে বদরুন্নেসা দেখা করেন হোসেন শহীদ সোরওয়ার্দী এবং আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী তরুন শেখ মুজিবর রহমানের সাথে। বদরুন্নেসার সাহস ও ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে মনোনয়ন দিতে রাজী হলেন যুক্তফ্রন্টের নেতারা।
বদরুন্নেসা ঠিক করলেন নির্বাচন করবেন নিজের শ্বশুর বাড়ীর এলাকা অর্থাৎ কুষ্টিয়া থেকে। শ্বশুর বাড়ীর এলাকার আওয়ামীলীগের সমর্থন পেয়ে বদরুন্নেসার প্রথম নির্বাচনী এলাকা ঠিক হয় কুষ্টিয়া-খুলনা-যশোর-ফরিদপুর পৌরসভা।
নিজের তিন সন্তান যাদের সব থেকে বড় জনের বয়স তখন ছয় আর ছোট জনের বয়স দেড়, তাদের সাথে নিয়ে বদরুন্নেসা নামেন নির্বাচনের লড়াইয়ে। নিজের বড় বোন এবং নুরউদ্দিন আহমেদের মেজ ভাই ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ হলেন তার প্রধান সারথি। নুরউদ্দিন আহমেদ এর মিয়া ভাই তাজউদ্দিন আহমেদও দায়িত্ব নিলেন কুষ্টিয়ার ভোট দেখতে। সেজ ভাই বদরুদ্দিন আহমেদ কাজ করলেন সমান তালে। বদরুন্নেসার স্বামী নুরউদ্দিন আহমেদ তখন সিলেটের কর্মক্ষেত্রে, তার ছুটি নেই।
একবার ভাবুন, ১৯৫৪ সালে এক আধুনিক শিক্ষিত বাঙ্গালী নারী, তিনটা বাচ্চা কোলে নিয়ে মানুষের বাড়ী বড়ী গিয়ে ভোট চাচ্ছেন,যখন এই দেশে নারীদের জন্য কিছুই সহজ ছিল না, প্রগতিকে দেখা হত অনেকটা নিষিদ্ধ চোখে। সমাজের একধরনের বাঁকা চোখ উপেক্ষা করে বদরুন্নেসা সেসময় ছিনিয়ে আনলেন বিপুল ব্যবধানের বিজয়। নির্বাচিত হলেন প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য।
এই সময়টাতে দেশের পরিস্থিতি উত্তাল হতে শুরু করে। কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের শ্রমিকদের সাথে মিলিটারি সরকার বিরোধী আন্দোলনে একাত্বতা জানিয়ে একমাসের জন্য কারাবাসে থাকেন,ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ।
বেগম বদরুন্নেসা এরপরে তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন আইণসভার সদস্য। মৃত্যুর দিন অবধি তিনি দায়িত্ব পালণ করেছেন নারী শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রীর দায়ীত্বে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দুইজন নারী প্রতিমন্ত্রীর,একজন।
১৯৬০ সালে বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ লালমায়টিয়া মহিলা কলেজে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে চাকরী শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে প্রিন্সিপাল থাকাকালীন মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে, লালমাটিয়া মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
ষাটের দশকের প্রথমার্ধে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার সড়কের ৬৭৮ নম্বর বাড়ীতে স্থায়ী আবাসন গড়েন নুরুউদ্দিন-বদরুন্নেসা দম্পত্তি। ৬৭৭ নম্বর বাড়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের, যিনি সেই সময় লাগাতার ভাবে পাকিস্থান সরকার নজরদারীতে থাকতেন। পাকিস্থান সরকারের নজর এড়িয়ে বেগম বদরুন্নেসার ৬৭৮ নাম্বার বাড়ীতে চা-পার্টির আড়ালে গোপন শলা পরামর্শ করতে দেশের কেন্দ্রীয় নেতারা জড় হতেন। যেইসব মিটিং এ উপস্থিত থাকতেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে ও আন্দোলনে নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ‘বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামীলীগ’ অংশ চালু করেন এবং বেগম বদরুন্নেসা হন বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
সেই সময় বেগম বদরুন্নেসা প্রতিষ্ঠা করেন গণসাংস্কৃতিক পরিষদ। যার উদ্দেশ্যে ছিল, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে তোলা।
১৯৭১ সালে বেগম বদরুন্নেসা ভারতের শরনার্থী শিবিরে রামকৃষ্ণ মিশন ও সারদা সেবা সংঘের সহায়তায় বাংলাদেশী রিফিউজি ক্যাম্পগুলাতে খাদ্য পৌছে দেওয়া একই সাথে তার অন্যতম দায়িত্ব ছিল, বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্পের তত্বাবধান এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে রিফিউজি ক্যাম্প সমূহের হালনাগাদ তথ্য রিপোর্ট করা। দেশ স্বাধীনের পরে বেগম বদরুন্নেসা প্রতিষ্ঠা করেন, Bangladesh Women’s Rehabilitation and Welfare Centre । যেখানে বীরঙ্গনাদের আশ্রয় দেওয়া হত। বেগম বদরুন্নেসার অধীনেই রাজতীতিতে আসেন, আইভি রহমান, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সাহারা খাতুন সহ অসংখ্য নারী নেত্রী।
১৯৫৪ সাল থেকে রাজনীতি জড়িয়ে পরলেও স্বাধীনচেতা বেগম বদরুন্নেসা তার সংসার ধর্মত্যাগ করেন নি। ২৭ বছরের সংসার জীবনের হাল তিনিই ধরে রেখেছিলেন। একদিকে স্বামীর ব্যাস্ত অফিস জীবন,ঘনঘন বদলি সেই সাথে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও শিক্ষকতা, সবকিছুকেই সমানভাবে সামলে রেখেছিলন। মোট কথা, বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ ছিলেন নারী প্রগতির এক বলিষ্ঠ উদাহরণ।
বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ ২৫ শে মে ১৯৭৪ সালে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান “বকসী বাজার মহিলা কলেজ” কে, “বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ” নামকরণ করেন।
তাঁর মৃত্যের ২৫ বছর পরে, ১৯৯৯ সালে বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।
তিনি নেই, কিন্তু তাঁর কাজগুলা থেকে গেছে, থেকে গেছে তাঁর রেখে যাওয়ার সম্পর্কের বন্ধন। তারপরও হয়তো সময়ের নিয়ম মেনেই স্মৃতির বইয়ে ধূলো পড়ছে,আস্তে আস্তে পৃষ্ঠাগুলাও মলিন হচ্ছে। সঠিক উদ্যোগ যদি না থাকে একদিন হয়ত পৃষ্ঠাগুলাও ছিঁড়ে যাবে। শুধু আমরাই পারি এই পৃষ্ঠাগুলাকে সযত্নে ধরে রাখতে। পুরাতন বইকে নতুনের রূপ দিতে।
এটা হয়তোবা ঝাপসা হয়ে আসা বেগম বদরুন্নেসা আহমেদের স্মৃতির স্মরণে, তৃতীয় প্রজন্মের এক কালির দাগ মাত্র।
তথ্য সূত্রঃ
১৷ জীবনের বনে বনে (নুরউদ্দিন আহমেদের জীবনী)।
২। বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ উইকিপিডিয়া পেজ।
৩। বিভিন্ন পত্রিকার আর্টিক্যাল।