ব্যর্থ সমাজ
এম, এ হক
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আমাদের সমাজ সম্পর্কে লব্ধ অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে দেখা যাবে, আমরা আমাদের চেনাজানা গলিতেই ঘুরছি।
আমরা সবসময় যা বিশ্বাস করেছি তাই মরিয়া হয়ে চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি চক্রাকার বৃত্তে ঘুরপাক খেয়ে নিজেদেরকে ক্লান্ত করে ফেলছি৷
বাংলাদেশ কি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর কাছে পিরিচিতি পেতে যাচ্ছে?
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে হাজারেরও বেশী মানুষ প্রাণ দিয়েছেন।
তাদের এই প্রত্যাশা কি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে?
আমাদের বর্তমান কাঠামোর মধ্যে থাকা কিছু সমস্যা যা আমরা খুব সহজেই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম কিন্তু তারপরও আমরা বারে বারে ব্যর্থ।
একটি সমাজে যখন ক্রমাগত সংঘাত, দুর্নীতি বা দমন পীড়ন অতিমাত্রায় পরিলক্ষিত হয় তখন তা একটি ব্যর্থ সমাজ হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি গণতন্ত্রের অভাব, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব বা রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণেও হতে পারে।
আর এই সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের দেবতার মতো করে পূজা-অর্চনা করা হয়। আর এক দলের দেবতাকে অন্য দল সহ্য করতে পারেনা।
খুব কম লোকই অসংলগ্ন শিক্ষাব্যবস্থা, স্ফীত এবং ভারসাম্যহীন স্বাস্থ্যসেবায় পদ্ধতিগত সমস্যাগুলি লক্ষ্য করবে।
ব্যর্থ সমাজে মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে জেগে ওঠেনা। জেগে ওঠে শ্লোগানে। উপসানালয় বেশী থাকে। উপাসনালয়গুলো আবার সপ্তাহের ছয়দিনই খালি পড়ে থাকে।
সমাজপতিরা অবশ্যই এই বিষয়গুলি সম্পর্কে আলোচনা করে, কিন্তু তারা যা করে তা হল অঙ্গুলি নির্দেশ।
যে সমাজ তার নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজন, সুযোগ বা অধিকার প্রদান করতে অক্ষম তাকেও ব্যর্থ সমাজ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
ব্যর্থ সমাজে প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের বিপরীতে হাজার হাজার বোকা থাকে এবং প্রতিটি সচেতন শব্দের বিপরীতে থাকে হাজার হাজার বস্তা পঁচা শব্দ। তারা সমস্যার উপরে ভেসে বেড়ায় কিন্তু এর গভীরে প্রবেশ করতে পারেনা। এর কারণ, শিক্ষাসহ অন্যান্য সুযোগের অভাব।
যে সমাজে অতিমাত্রায় অপরাধ ও সহিংসতা দেখা দেয় তাও ব্যর্থ সমাজ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এর কারণ হতে পারে সামাজিক সংহতি অথবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার অভাব।
সমাজের অতি তুচ্ছ বিষয়গুলি নিয়ে মানুষ আলোচনায় মেতে থাকে। মূল বিষয়গুলো হারিয়ে যায়। সমস্যা সমাধানের চেয়ে একে অন্যের উপর প্রতিনিয়ত দোষ চাপাতে থাকে।
এগুলি ঠিক করারও নীতি আছে, কিন্তু এক রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলের উপর দোষ চাপাতে ব্যস্ত। কিন্তু এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এই ভারসাম্যহীনতা এবং অব্যবস্থাপনা সবই অর্থ সম্পর্কিত এবং যারা এই অর্থকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের থেকেই উদ্ভূত।
ব্যর্থ সমাজে লক্ষ লক্ষ মানুষ অর্থহীন সস্তা বিনোদনের পিছনে ছুটে। যার ফলে, সস্তা বিনোদন করেও মানুষ প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জনও করে, যেমন- টিকটক। ব্যর্থ সমাজব্যবস্থায় যে কোনো একটা খেলা দিয়ে মানুষকে দিনের পর দিন নেশাগ্রস্থ করে রাখা হয়।
যে সমাজ তার প্রাকৃতিক সম্পদকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে বা পরিবেশ রক্ষা করতে অক্ষম হয় তাকেও ব্যর্থ সমাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি পরিবেশের গুরুত্ব বোঝার ও নিয়ন্ত্রণের অভাব বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সম্পদের অভাবের কারণেও হতে পারে।
ব্যর্থ সমাজে চিন্তাশীল মানুষের মূল্য বা ওজন কেউ বোঝেনা। অধিকাংশ মানুষ আজে-বাজে কথায় সময় পার করে দেয়। সস্তা বিনোদনের মাধ্যমে যে মানুষকে হাসায়, তার চেয়ে কঠিন সত্য বলে যে বাস্তবতাকে জাগিয়ে তোলে তাকে কেউ গ্রহণ করেনা।
অজ্ঞ সংখ্যাগরিষ্ঠরা এখানে আপনার ভাগ্য নির্ধারণ করে। সবার যেমন একটি করে পশ্চাতদেশ থাকে। ঠিক তেমনি ব্যর্থ সমাজে যে কোনো বিষয়ের উপর সবার একটি করে মতামতও থাকে।
মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, কোনো সমাজই নিখুঁত নয়। সব সমাজই চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার সম্মুখীন হয়। যাইহোক, যে সমাজ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে এবং কাটিয়ে উঠতে সক্ষম তাদেরই সফলতা এবং উন্নতির সম্ভাবনা বেশী।
ব্যর্থ সমাজে মানুষ ব্যর্থ হয়না, এখানে সচতুরভাবে তাকে ব্যর্থ বানানো হয়।