বাংলাদেশঃ রাজনৈতিক সংকট, সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও ভূরাজনৈতিক উত্তাপের গভীর বিশ্লেষণ

Illustration: Ratna Sagar Shrestha/THT


এম, এ হক

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য, ডঃ মোহাম্মদ ইউনুসের পদত্যাগের গুজব এবং নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জাগছে। এছাড়া মানবিক করিডোর ও চট্টগ্রাম বন্দরের বিদেশী হস্তান্তর, অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক এখতিয়ার, প্রক্সি যুদ্ধের আশঙ্কা এবং বিএনপির অবস্থান নিয়ে চলছে তীব্র বিতর্ক। এই প্রতিবেদনে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীর বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞ‌দের মতামত উপস্থাপন করা হল।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্প্রতি “ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচন” অনুষ্ঠানের জোর দাবী জানিয়েছেন, যা তিনি জাতীয় স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেছেন । তিনি সতর্ক করেছেন যে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার “বিদেশী শক্তির জন্য বাংলাদেশকে প্রক্সি যুদ্ধের ময়দানে পরিণত করতে পারে”। এছাড়া, মব ভায়োলেন্স-এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং চট্টগ্রাম বন্দর ও মানবিক করিডোরের মত নীতিগত সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন । 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডঃ তাসনিম সিদ্দিকী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) মন্তব্য করেন, “সেনাপ্রধানের বক্তব্য প্রশাসনের দুর্বলতা এবং সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে”। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা (রয়টার্স) মনে করেন, সামরিক নেতৃত্বের এমন মন্তব্য প্রায়শই রাজনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস দেয়। 

নোবেলজয়ী ডঃ মোহাম্মদ ইউনুসের পদত্যাগের গুজবকে “সরকারবিরোধী শক্তিকে দমনের কৌশল” হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। সেনাপ্রধান পরোক্ষভাবে ইউনুস-নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এবং ইউনুস-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর সমালোচনা করে বলেছেন, “জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য”। সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো গুজবের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের স্বার্থ জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে, যা রাখাইন মানবিক করিডোর ও বিদেশী সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের প্রস্তাবের সাথে সম্পর্কিত । 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এটিকে “সিভিল সোসাইটি দমনের প্রচেষ্টা” বলে উল্লেখ করেছে । 

এনসিপি-এর মব ভায়োলেন্সঃ
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-পৃষ্ঠপোষিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-এর নামে সংঘটিত মব ভায়োলেন্সকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী “রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি” হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেনের মতে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সংবিধানসম্মত কিন্তু সহিংসতা দণ্ডনীয় । অন্যদিকে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো অভিযোগ করছে, “রাষ্ট্রীয় সহিংসতা”-র মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন করা হচ্ছে । 

এদি‌কে মিয়ানমারের রাখাইনে প্রস্তাবিত করিডোর নিয়ে উত্তেজনা তৈরী হয়েছে। সেনাপ্রধান জোর দিয়ে বলেছেন, “রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোই অগ্রাধিকার” এবং এ ধরনের সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র নির্বাচিত সরকার নিতে পারবে । 
এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী কোম্পানীর কাছে ৩০% অপারেশন হস্তান্তর নিয়ে অর্থনীতিবিদ ডঃ জাহিদ হোসেন সতর্ক করেছেন, “এটি অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি”। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন কর্মকর্তা ডঃ মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম মনে করেন, বিনিয়োগে কর্মসংস্থান বাড়বে । 

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডঃ শাহদীন মালিকের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব শুধু তত্ত্বাবধায়কের, তাই বন্দর চুক্তি বা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত । সেনাপ্রধানও একইভাবে মত দিয়েছেন যে “রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত”। 

কৌশলগত বিশ্লেষক প্রফেসর ডেলরোজ জামান (এশিয়ান ইউনিভার্সিটি) সতর্ক করেছেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ ও ভারত-মার্কিন প্রভাব-এর টানাপোড়ন বাংলাদেশকে “ভূরাজনৈতিক সংঘা‌তের টার্ফ” বানাচ্ছে । সেনাপ্রধানও ইঙ্গিত দিয়েছেন, বিদেশী শক্তি বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চাইছে । 

এদি‌কে বিএনপি নি‌জে‌দের “গত ১৭ বছরের স্বৈরাচারী অপশাসনের শিকার” দাবী করে এবং তারা মানবিক করিডোরের বিরোধীতা করলেও তাদের অবস্থান অস্পষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে দলটি সাংগঠনিক পুনর্গঠনে ব্যস্ত তবে নির্বাচনের আগে সক্রিয় আন্দোলনের কোনো লক্ষণ নেই । 
অপর‌দি‌কে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি সম‌র্থিত ইশরাক হোসেনের মেয়র পদে নিযুক্তিকে “আন্দোলন ঠেকানোর কৌশল” হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি বিএনপিকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়ানো থেকে বিরত রাখার চেষ্টা। 

রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিবেশগত সংকট ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সামাজিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগ ও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগীতা বাংলাদেশকে সংঘাতের কেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারে। 

এক্ষে‌ত্রে পরামর্শ হ‌চ্ছে, ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। সংবিধান মেনে অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত ভূমিকা নিশ্চিত করা। বিদেশী নির্ভরতা কমানো এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *