পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী “বাকরখানি”

এম, এ হক
মুঘোল আমলের এক করুণ প্রেমের কাহিনীর স্মারক বাকরখানির উৎপত্তি। মুঘোল, ইংরেজ ও পাকিস্তান আমলে এর জৌলুস থাকলেও সময়ের সঙ্গে ফাস্টফুড ও আধুনিক খাবারের দাপটে এটি হারিয়ে যেতে বসেছে। পুরান ঢাকা, খিলগাঁও, সিপাহীবাগে এখনও বাকরখানির দোকান খুঁজে পাওয়া যায়। জিঞ্জিরার তন্দুরে তৈরি রুটিগুলো এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিরমাল, চা’পাতার মতো বাকরখানিও বিলুপ্তির পথে। তবে এর রোমাঞ্চকর অতীত এখনও আমাদের মনে ইতিহাসের গন্ধ ছড়ায়। বাকরখানি শুধু একটি খাবার নয়, এটি আমাদের অতীতের জীবন্ত সাক্ষী।
এবার আসি এর ইতিহাস কথনে, এ বিষয়ে জানা যায় কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থের লেখক নাজির হোসেনের লেখনীতে। তিনি লিখেছেন বাকরখানি রুটির সাথে যার নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত তিনি হলেন আগা বাকের ও আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম।
আগা বাকের ছিলেন তুর্কিস্তানের মতান্তরে ইরানের অধিবাসী। তিনি শিয়া মুসলিম ছিলেন। ভাগ্যন্বেষণে তিনি ভারতবর্ষে আগমন করেন এবং মুর্শিদকুলী খার বিশেষ স্নেহ ও আশ্রয় লাভ করেন এবং নিজ দক্ষতায় তার সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন হন। তিনি চট্টগ্রামের ফৌজদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার ছেলের নাম আগা সাদেক যার নামে পুরনো ঢাকাতে একটি সড়কের নামও রয়েছে। আর খনি বেগম সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। যতটুকু জানা গেছে তা হলো- তিনি আরামবাগের নর্তকী ছিলেন। এই খনি বেগমকে নিয়ে অনেক জলঘোলা ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে তদসাথে প্রাণহানিও।
যাহোক, আগা বাকের ও খনি বেগম একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন । বাকেরের এই প্রেমের সম্পর্কে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উজিরেআলা জাহান্দর খার দুশ্চরিত্র পুত্র কোতোয়াল জয়নুল খাঁ। এসব ব্যাপারে মুর্শিদকুলী খাঁ কিছু জানতেন না। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে খনি বেগমের সতীত্ব নষ্ট করতে চেষ্টা করেন কোতোয়াল জয়নুল খাঁ। সংবাদ পেয়ে আগা বাকের বাঁধা দিলে উভয়ের মাঝে যুদ্ধ বেঁধে যায়। যুদ্ধে হেরে জয়নুল খাঁ পালিয়ে যান। জয়নুলের বন্ধুগন এটাকে অন্যরূপ দিয়ে গুজব ছড়িয়ে দিল যে বাকের জয়নুলকে হত্যা করে মৃতদেহ গুম করে দিয়েছে। এ অভিযোগ নবাবের দরবারে গেলে ন্যয়পরায়ণ মুর্শিদকুলী খাঁ পূত্রবৎ বাকেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেন। দমবার পাত্র ছিলেন না বাকের। বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বাঘটিকে হত্যা করে বিজয়ীর বেশে খাঁচা হতে বেরিয়ে আসেন। এদিকে জয়নুল সুযোগ বুঝে জোরপূর্বক খনি বেগমকে অপহরণ করে দক্ষিন পূর্ব বঙ্গের ভাটি অঞ্চলের এক গভীর অরণ্যে পালিয়ে যান। জয়নুল শত চেষ্টা করেও খনি বেগমকে বশে আনতে না পেরে তাকে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে (বাকেরগঞ্জ/বরিশাল) বন্দী করে রাখেন। এ খবর আগা বাকেরের কানে পৌঁছালে তিনি সেনাপতি কালা গাজীকে নিয়ে ছুটে যান চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে। জয়নুলের পিতাও তার চরিত্রহীন ছেলের কার্যকলাপে অতিষ্ট হয়ে ছেলেকে শিক্ষা দেয়ার জন্য তথায় হাজির হলেন এবং পুত্রকে বন্দী করে শাস্তিস্বরূপ নিজ তরবারি দিয়ে আঘাত করলেন। অসির আঘাতে মরণাপন্ন জয়নুল দেখল যে সে আর বাঁচবে না এবং খনিকেও পাবে না তাই সুযোগ বুঝে সে খনি বেগমের বুকে অসি বসিয়ে দিল প্রতিশোধস্বরূপ। এ আঘাতে খনি বেগম যখন মৃত্যু পথযাত্রী তখন সেখানে হাজির হন আগা বাকের; খনি বেগমকে বুকে তুলে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন বাকের। এক পর্যায়ে খনি বেগম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। খনির মৃত্যুতে প্রায় উন্মাদ হয়ে যান বাকের। রাজ্য ও মসনদের সকল আকর্ষন পরিত্যাগ করে সেই অঞ্চলেই থেকে যান তিনি। শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ্যায়। পরবর্তীতে বুজুর্গ উমেদপুরের জমিদারি লাভ করার পর সেলিমাবাদ ও চন্দ্রদ্বীপ পরগনা দখল করে নেন। বহু দ্বীপ নিয়ে গঠিত বাখলা চন্দ্রদ্বীপের জমিদারি লাভ করেন আগা বাকের। পরবর্তীতে ১৭৯৭ সালে ইংরেজ সরকার যখন পৃথক জেলা গঠন করেন তখন এই জনপ্রিয় ব্যাক্তির নামটিকে অস্বীকার না করে তার নামেই নামকরণ করা হয় বাকেরগঞ্জ জেলা। এরপর মুর্শিদ কুলী খাঁর আদেশে আগা বাকের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে করেন। সে ঘরে জন্ম লাভ করে আগা সাদেক ও মির্জা মাহদী নামে দুই পুত্র।
আগা বাকের নবাব সিরাজউদ্দোলার দুর্দিনে তার পাশেই ছিলেন। নবাব বিরোধী শিবির রাজবল্লভ ও ঘসেটি বেগমের বিরুদ্ধেও তিনি ভীষণ সরব ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঢাকার নায়েব নাজিম হোসেন উদ্দিন খানের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে আগা বাকের নিহত হন। রাজবল্লভ তার দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলেন। বাকেরের এই খণ্ডিত দেহ পরে আগা সাদেক ময়দানে সমাহিত করা হয়।
আগা বাকের অন্য নারীকে বিয়ে করলেও তার মন থেকে খনি বেগমের স্মৃতি মুছে যায়নি। তার প্রমাণ- বিশেষভাবে তৈরী তার প্রিয় খাদ্য তথা রুটির নাম তার প্রেম কাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নামকরণ করা হয়েছিল “বাকর-খনি” রুটি যা কিছুটা অপভ্রংশ হয়ে, হয়েছে বাকরখানি রুটি। এটি টিকে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। পুরনো ঢাকার আদি খাবারগুলোর মধ্যে এটি একটি অন্যতম খাবার। বাকরখানি পুরান ঢাকাবাসীর সকালের নাস্তা হিসেবে প্রচলিত ছিল আদিতে।
বাকরখানি মূলতঃ আদি ঢাকা তথা পুরনো ঢাকাবাসীর একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। পরবর্তীতে এটি বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়েছে। সকাল ও বিকেলের নাস্তায় এটি একসময় পুরনো ঢাকাবাসীর কাছে তুমুল জনপ্রিয় ছিল। এখনও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাকরখানি রুটির পুরনো দোকান ও তন্দুর সগৌরবে টিকে আছে।