নালন্দা মঠ, বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সত্যতা
এম, এ হক
বঙ্গবিজেতা বখতিয়ার খিলজি মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে বঙ্গবিজয় করেছিলেন ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে।
তখন বাংলায় সেন বংশের শাসক লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকাল। সেন বংশের শাসন নিম্নবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধদের জন্য মোটেও সুখকর ছিলনা। এরকম পরিস্থিতিতে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ ঘটে আর লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে যান। পরে এই আক্রমণের উপরেই ভিত্তি করে বহু ঐতিহাসিক নিজেদের মনমত বখতিয়ার খিলজির উপর বেশকিছু অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তার মধ্যে মূল অভিযোগ হলো নালন্দা ধ্বংস।
বখতিয়ার খিলজির উপর বড়োজোর উদন্তপুরী আক্রমণের অভিযোগ চাপানো যায়,যেটা নালন্দা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মগধে অবস্থিত। তার বেশী কিছু না। যদিও এই উদন্তপুরী আক্রমণ হয়েছিল ভুল তথ্যের কারণে। বখতিয়ার খিলজি উদন্তপুরীকে সেনাশিবির ভেবে আক্রমণ করেছিলেন।
তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, বখতিয়ারকে উদন্তপুরী আক্রমণ করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল স্থানীয়রা। পণ্ডিত কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রী তাঁর ‘ভাদ্র কল্পদ্রুম’ এ লিখেনঃ-
❝বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পণ্ডিতদের মধ্যে কলহ ও বিবাদ চলছিল। তা এমনই তীব্র ছিলো যে তাদের এক পক্ষ তুর্কী আক্রমণকারীদেরকে তাদের ওখানে আক্রমণ চালাতে প্রতিনিধি পাঠায়।❞
এমনকি বখতিয়ার খিলজির হয়ে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু নদীয়া আক্রমণের সময় গুপ্তচরবৃত্তিও করেছিল।
যাইহোক ঐতিহাসিক মিনহাজের বিবরণে জানা যায় উদন্তপুরী একটা শিক্ষাপীঠ ছিলো। আর বখতিয়ার সেটা জানতেন না।
তবে ঐতিহাসিক মিনহাজের বিবরণও সন্দেহজনক। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে উদন্তপুরী বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে,অন্যান্য গনেষকদের মতে ১১৯১-৯৩ এর মধ্যে। আর বখতিয়ার খিলজি আক্রমণ ঘটে ১২০৪ সালে। আর এই মিনহাজের বিবরণকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বানোয়াটও বলেছেন।
এবার আসা যাক নালন্দা আক্রমণ নিয়ে। নালন্দা আক্রমণ নিয়ে বললে বলতে হয় বখতিয়ার খিলজি কখনো নালন্দাতেই যাননি।
প্রফেসর ডি এন ঝাঁ তার বই Against The Grain: Notes On Identify তে বলেছেন বখতিয়ার খিলজি কখনো নালন্দায় যাননি।
গবেষক লেখক অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেনঃ-
❝বখতিয়ারের বিরুদ্ধে নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার নিরঙ্কুশ অপবাদ বহুল প্রচারিত। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১০০ সালে বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করেছেন। ভারতীয় ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বখতিয়ারের এই আক্রমণের তারিখ জানিয়েছেন ১১০০ সাল। অথচ স্যার উলসলি হেগ বলছেন, বখতিয়ার উদন্তপুরী আক্রমণ করেছেন ১১৯৩ সালে। আর স্যার যদুনাথ সরকার এই আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ সাল। উল্লেখ্য যে, বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয় করেন ১২০৪ সালের ১০ মে। স্যার যদুনাথ সরকার বখতিয়ারের বঙ্গ আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ সাল। অন্যদিকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে বৌদ্ধদের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩ সালে। যে লোকটি ১২০৪ সালে বঙ্গে প্রবেশ করেন, সে কীভাবে ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংস করেন?❞
তাহলে দেখা যাচ্ছে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের আগেই নালন্দা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
তিনি আরো লিখেনঃ-
❝ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যাচ্ছে, ধ্বংস করা তো দূরের কথা, বখতিয়ার নালন্দার ধারেকাছেই যাননি।❞
যদুনাথ সরকার অবশ্য চেষ্টা করেছেন বখতিয়ার খিলজির আক্রমণকে ১২০৪ থেকে পিছিয়ে ১১৯৯ আনার, কিন্তু তাতেও ধ্বংসের দায় তাঁর উপর চাপেনা।
শরৎচন্দ্র দাশ তাঁর Antiquity of Chittagong প্রবন্ধে লিখেছেন, ❝বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী বিহার দুটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল ১২০২ সালে।❞
এই তালিকায় কিন্তু নালন্দার উল্লেখ নেই।
লামা তারানাথ এবিষয়ে তার লেখা “ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস” (১৬০৮খ্রিঃ) বইতে পরিস্কারভাবে বলেছেন। তিনি কেবল উদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা মহাবিহারে আক্রমণের উল্লেখ করেছেন,নালন্দার নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। তিনি বলেনঃ-
❝Then came the Turuska king called the Moon to the region of Antarvedi in-between the Ganga and the Yamuna. Some of the monks acted as the messengers for this king. As a result, the petty Turuska rulers of Bhangala and other places united, ran over whole of Magadhaand massacred many ordained monks in Odantapuri. They destroyed this and also Vikramasila. The Persians at last built a fort on the ruins of the Odanta-vihara.❞
১২৩৪-৩৬ সাল নাগাদ, অর্থাৎ বখতিয়ারের (মৃত্যু হয় ১২০৬ সালে) বিহার জয়ের ৩১ বছর পরও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় চালু ছিল। সেসময়ে তিব্বত থেকে ধর্মস্বামী এসে নালন্দা বিহারকে চালু অবস্থাতেই দেখেছেন। সেখানে মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্রের পরিচালনায় ৭০ জন সাধু পড়াশোনা করেছেন।
এবার কথা হলো ধ্বংসের কথা বারবার লেখা হয়, বলা হয় তাহলে যদি ধরেই নি ধ্বংস হয়েছিল, তাহলে সেটা করেছিলো কে বা কারা?
স্বামী বিবেকানন্দের দাদা ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন
❝নালন্দায় লাইব্রেরী কয়েকবার বিধ্বস্ত হয়। P. al. Jor-এর তিব্বতীয় পুস্তকে উল্লিখিত হয়েছে যে, “ধর্মসগন্ধ অর্থাৎ নালন্দার বৃহৎ লাইব্রেরী তিনটি মন্দিরে রক্ষিত ছিল। তীর্থিক (ব্রাহ্মণ) ভিক্ষুদের দ্বারা অগ্নিসংযোগে তাহা ধ্বংস হয়। মগধের রাজমন্ত্রী কুকুতসিদ্ধ নালন্দায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে ধর্মোপদেশ প্রদানকালে জনাকতক তরুণ ভিক্ষু দুজন তীর্থিক ভিক্ষুদের গায়ে নোংরা জল ছিটিয়ে দেয়। তার ফলে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নধনুক’ এবং নয়তলাযুক্ত ‘রত্নদধি’ নামক তিনটি মন্দির অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে। উক্ত তিনটি মন্দিরেই সমষ্টিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাগার ছিল।❞
P. al. Jor: History of the Rise, Progress and Downfall of Buddhism in India গ্রন্থটা পড়ে দেখতে পারেন।
বুদ্ধপ্ৰকাশ তাঁর ‘Aspects of Indian History and Civilisation’ গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেনঃ-
❝নালন্দায় অগ্নিসংযোগের জন্য হিন্দুরাই দায়ী।❞
বাংলাদেশে ‘বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ ভিক্ষু’ গ্রন্থে ভিক্ষু সুনীথানন্দ বলেনঃ-
❝এজন্য কেবল ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই দায়ী।❞
মুসলিমবিদ্বেষী লেখক আর্নেস্ট হ্যাভেল লিখেছেনঃ-
❝মুসলমান রাজনৈতিক মতবাদ শুদ্রকে দিয়েছে মুক্ত মানুষের অধিকার, আর ব্রাহ্মণদের ওপরেও প্রভুত্ব করার ক্ষমতা। ইউরোপের পুনর্জাগরণের মত চিন্তাজগতে এটি তুলেছে তরঙ্গাভিঘাত, জন্ম দিয়েছে অগণিত দৃঢ় মানুষের আর অনেক অত্যোদ্ভুত মৌলিক প্রতিভার। পুনর্জাগরণের মতোই এও ছিল মূলত এক পৌঢ় আদর্শ। এরই ফলে গড়ে উঠল বাঁচার আনন্দে পরিপূর্ণ এক বিরাট মানবতা। সেই মানবতার দ্বার উন্মোচনে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গজয় ছিল প্রশ্নহীন এক মাইলফলক। বৌদ্ধদের জন্য যা ছিল অনেক বেশী গ্লানিমুক্তির। অনেকটা নবজীবন। মুসলিম বিজয় তাদের কোনো কিছু ধ্বংস করেনি, বিপন্ন করেনি তাদের বরং খুলে দিয়েছে মুক্তির সদর দরজা।❞
দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায়,
❝মুসলমানগণ কর্তৃক বঙ্গবিজয়কে বৌদ্ধরা ভগবানের দানরূপে মেনে নিয়েছিল।❞
নালন্দার ধ্বংস মুসলিমদের হাতে হলে মুসলিম বিজয়কে কেন বৌদ্ধরা ভগবানের অনুদান মনে করবেন?
ষষ্ঠ শতকের রাজা মিহিরকুল বৌদ্ধদের সহ্য করতে পারতেন না। তিনি যখন পাটলিপুত্র আক্রমণ করেন সম্ভবত তখনই নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
এইচ হিরাস এ বিষয়ে লিখেছেনঃ-
❝Nalanda University was not far from the capital, Pataliputra and its fame had also reached Mihirakula’s ears. The buildings of Nalanda were then probably destroyed for the first time and its priests and students dis-persed and perhaps killed.❞
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় নালন্দা প্রথমবার আক্রমণের স্বীকার হয় শৈব রাজা মিহিরকুলের দ্বারা, এরপর গৌড়রাজ শশাঙ্কের দ্বারা, এরপর তিরহুতের রাজা অর্জুনের একদল ব্রাহ্মণের হাতে আবারও নালন্দা আক্রান্ত হয়।
ঐতিহাসিক এস, সদাশিবন অবশ্য নালন্দা ধ্বংসের জন্য মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয়কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।
পঞ্চম শতাব্দীতে ব্রাহ্মণরা যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে ও বৌদ্ধ বিহারগুলিতে অগ্নিসংযোগ করেন।ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়।
তিব্বতীয় শাস্ত্র “পাগসাম ইয়ান জাং”-এ ব্রাহ্মণরা নালন্দার লাইব্রেরি পুড়িয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক ডি আর পাটিল পরিস্কারভাবে বলেছেনঃ-
❝ওটা ধ্বংস করেছে শৈবরা।❞
তিনি এ-ও বলেছেন নালন্দা ধ্বংস হয়েছিল বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের আগেই।
শৈবরাই নালন্দা ধ্বংস করেছে এই বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন আর এস শর্মা ও কে এম শ্রীমালি।
বখতিয়ার খিলজীকে দায়ী করার অপচেষ্টা অধিকাংশ ঐতিহাসিক নাকচ করে দিয়েছেন।
এবিষয়ে দেখা যেতে পারেঃ-
Truschke, A. 2018. The Power of The islamic Sword in Narrating The Death of Indian Buddhism, Journal of The History of Religion, Chicago University press.
রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী লিপিতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন যে, নালন্দা ধ্বংসের সাথে বিজয় সেনের সম্পর্ক আছে।
এবিষয় উল্লেখিত আছে, Chaudhary, R. 1978. Decline of the University of Vikramasila, Journal of the Indian History.
রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী নালন্দায় ১৯৬০-৭২ সাল পর্যন্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের উপর ভিত্তি করে Decline of The University of Vikramasila প্রবন্ধ লিখে সুন্দর করে দেখিয়েছেন যে বখতিয়ার খিলজীর বাংলায় আগমনের সাথে নালন্দার ধ্বংসের কোনো সম্পর্কই নেই।
তাহলে কি বোঝা গেলো?
আর বাংলায় মুসলিম শাসন বৌদ্ধরা কি হিসেবে দেখেছিলো এবিষয়ে জানতে চাইলে বিশদভাবে লেখা সম্ভব।
তথ্যসুত্রঃ
১.Journal of The Varendra Research society, 1940.
The Rise and Fall Of Buddhism in South Asia 2008.
২.বাংলায় মুসলিম সমাজ বিস্তারের প্রাথমিক ধারা, এ কে এম শাহনেওয়াজ।
৩.বাঙ্গালীর ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
৪.ভারতে ইসলাম ভারতীয় মুসলমান, অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৫.বায়োগ্রাফি অব ধর্মস্বামী জি রোয়েরিখ, কে পি জয়সওয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট,পাটনা।
৬. বাঙ্গলার ইতিহাস, ড. ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত।
৭.আর্নেস্ট হ্যাভেল, দি হিস্ট্রি অব এরিয়ান রুল ইন ইন্ডিয়া।
৮.এইচ হিরাস, দ্য রয়েল পেট্রনস অব দ্য ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা, জার্নাল অব দ্য বিহার এন্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সোসাইটি।
৯. এস এন সদাশিবন, এ সোসাইটি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া।
১০. P. al. jor: History of Rise, progress and Downfall of Buddhism in India
১১. বি এন এস যাদব, সোসাইটি এন্ড কালচার ইন নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইন দ্য টুয়েলভথ সেঞ্চুরি।
১২.ডি আর পাটিল, অ্যান্টিকোয়ারিয়ান রিমেনস অব বিহার (এটা বিহার সরকার কর্তৃক প্রকাশিত, নালন্দা ধ্বংসের উপর একমাত্র লিখিত গবেষণাপত্র)
১৩.আর এস শর্মা ও কে এম শ্রীমালি,এ কমপ্রিহেনসিভ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া।
এছাড়াও দেখতে পারেন
#বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগঃ মিথ ও বাস্তবতা, মুসা আল হাফিজ
#ভারতবর্ষের ইতিহাসঃ রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা,আমিনুল ইসলাম।