ঝাড়ুদার থে‌কে বিজ্ঞানী


এম,এ হক

সপ্তদশ শতাব্দীর ঘটনা। নেদারল্যান্ডের ডেলফট শহরে এক চশমার দোকানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে এক কিশোর। দোকানের কর্মচারীরা কাঁচ ঘসে চশমা তৈরী করে। সেটাই মন দিয়ে দেখে ছেলেটা।

ছেলেটার বাবা মারা গেছে কয়েক বছর আগে। আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাই স্কুলের পাঠ শেষ না করেই চাকরী নেয় এক মুদির দোকানে। মাইনে সামান্যই। এরই মধ্যে পৌরসভার একটা চাকরী জুটে যায়। বড় চাকরী নয়, ঝাড়ুদারের কাজ। পেট চালাতে হলে এ ছাড়া উপায়ই বা কী?

ছেলেটা চশমার দোকানে কাঁচ কাটা দেখে একটা ব্যাপার বুঝেছে। এক টুকরো কাঁচ ঘষে মাঝখানটা উঁচু করতে পারলে সেটা লেন্সে পরিণত হয়। তার ভেতর দিয়ে তাকালে ছোট জিনিস বড় দেখায়। ছেলেটা নিজেই এই জিনিস তৈরীর কথা ভাবে এক সময়। কাঁচ আরও সুন্দর করে ঘষে আরও নিখুঁত করে তুলতে পারলে সেটা আরও ভালো লেন্সে পরিণত হবে।

বাড়ী ফিরে সত্যি সত্যিই কাঁচ ঘষে লেন্স তৈরী করে ছেলেটা। চশমার দোকানের চেয়েও ভালো লেন্স। সেই লেন্সের ভেতর দিয়ে তাকালে যে জিনিস দু-তিন শ গুণ বড় দেখায়। ছেলেটার উৎসাহ আরও বাড়ে। আরও ভালো লেন্স তৈরী করে সে। তামার পাত দিয়ে তৈরী একটা ফাঁপা নলের মাথায় লাগিয়ে দেয় লেন্স। তৈরী হয় অণুবীক্ষণ যন্ত্র। আর ছেলেটার সামনে খুলে যায় খুদে প্রাণীদের এক অবিশ্বাস্য জগৎ।

প্রথম দিকে সামনে যা পেত, তা-ই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে দেখত।
ছেলেটার বয়স বাড়তে থাকে। কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নেশা তাঁকে ছাড়ে না। তিনি কাঁচ ঘসে ঘসে লেন্স বানান। আর একে একে প্রায় চারশ’টির মত অণুবীক্ষণ যন্ত্র বানিয়ে ফেলেন। একদিন কী মনে করে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে এক ফোঁটা পানি ফেলে পরীক্ষা শুরু করলেন। আর অমনি আরেকটা আশ্চর্য প্রাণীজগতের দুয়ার খুলে গেল। বিকট, ভয়ঙ্কর দর্শন সব জীব ঘুরে বেড়াচ্ছে ঐ এক ফোঁটা পা‌নির ভেতর। তাঁর অজান্তেই ঘটে গেল চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক মহাবিপ্লব।

লোকটা খুদে জিনিস-পত্র পর্যবেক্ষণ করেন আর সেগুলো খাতায় লি‌খে রাখেন। ভবিষ্যতে কোনো কাজে লাগবে ভেবে এটা করেননি। হয়তো নিজের পর্যবেক্ষেণেরই সুবিধা হবে। তিনি তখন পর্যন্ত ঝাড়ুদারির পেশা‌তেই নি‌য়ো‌জিত। তাই এটা যে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, সেটাই হয়তো বোঝেননি।

এর মধ্যে কেউ একজন জানায়, এই ব্যাপারটা যদি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির লোকজনকে জানায়, তাহলে হয়তো তাঁরা এর মর্ম বুঝবেন। কিন্তু তিনি একজন ঝাড়ুদার। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার মতো পয়সা তাঁর ছিল না। তাই রয়্যাল সোসাইটির ঠিকানা জোগাড় করে সেখানকার বিজ্ঞানীদের চিঠি লিখে জানালেন। রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা এটাকে আমল দিতেই চাননি। কিন্তু সবাই তো একরকম নন। কেউ কেউ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে লিউয়েনহুক ছাব্বিশটা অণুবীক্ষণ যন্ত্র পাঠিয়ে দিলেন রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানীদের ঠিকানায়।

রয়্যাল সোসাইটি তখন বিজ্ঞান জগতের হর্তাকর্তা। তাঁদের থেকে কোনো আবিষ্কারের স্বীকৃতি না পেলে বিজ্ঞান জগতে সেটার টিকে থাকা মুশকিল। এবার অণুবীক্ষণ যন্ত্র হাতে পেয়েছেন র‌য়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা। পরীক্ষা করে দেখতে তো আর দোষ নেই। কোনো কোনো বিজ্ঞানী সেই যন্ত্রের নলে চোখ লাগিয়ে দেখলেন, এতদিন ঝাড়ুদার লোকটা যা জানিয়েছেন তার সবই সত্যি।

সুতরাং তাঁকে রয়্যাল সোসাইটির সদস্য করে নেওয়া হল। বিশ্বের বড়-বড় বিজ্ঞানীরাই কেবল এই সোসাইটির সদস্য হতে পারেন। সুতরাং ঝাড়ুদারের সম্মান বাড়ল অনেকখানি। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য খোদ রাশিয়ার রাজা এবং ইংল্যান্ডের রাণী পর্যন্ত ডেলটফ নামের সেই ছোট্ট শহরে গিয়েছিলেন। পা ফেলেছিলেন তাঁর জীর্ণ কূটিরে।

সেই ঝাড়ুদার লোকটার নাম হলো
অ্যান্থনি ফিলিপ ভন লিউয়েন হুক। যিনি অনুবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *