জাতীয় নাগরিক পার্টিঃ (এনসিপি) সংস্কারের মুখোশ নাকি ক্ষমতার নতুন কৌশল?


এম, এ হক

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একটি নতুন সংযোজন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী তরুণদের দ্বারা গঠিত এই দলটি সংবিধান সংস্কার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং “সেকেন্ড রিপাবলিক” প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে । তবে তাদের কার্যক্রম ও বক্তব্য নিয়ে সমালোচকদের মধ্যে সন্দেহের কালো মেঘ জমেছে। কিছু প্রশ্ন অমীমাংসিতঃ এনসিপি কি সত্যিই পরিবর্তনের বার্তাবাহক, নাকি ক্ষমতা দখলের জন্য পুরনো রাজনীতিরই নতুন সংস্করণ?

এনসিপির মূল এজেন্ডা হলো “মৌলিক সংস্কার”। তাদের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
– একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন । 
– নিম্নকক্ষে সরাসরি নির্বাচন এবং উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব । 
– সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, যা সংসদ সদস্যদের দলত্যাগে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে । 
– গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন। 

তবে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর সাথে এনসিপির মতপার্থক্য প্রকট। বিএনপি সংস্কারকে “পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া” মনে করলেও এনসিপি জোর দিচ্ছে “মৌলিক পরিবর্তন” ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় । এই অনমনীয় অবস্থান তাদেরকে রাজনৈতিক আলোচনার টেবিলে নিয়ে গেলেও সমঝোতার অভাব ভবিষ্যৎ সংকটের ইঙ্গিত দেয়।

এনসিপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো “সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা” সমালোচকরা দাবী করেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে এনসিপির নেতাদের যোগসাজশ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপঃ
– দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পূর্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন, যদিও তিনি পদত্যাগ করেছেন । 
– অনুষ্ঠানে প্রশাসনের সহযোগীতায় গাড়ী বরাদ্দ এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানে এনসিপি সমর্থকদের নিয়োগের অভিযোগ । 
– বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদের মতে, “এনসিপি সরকারের ছত্রছায়ায় গঠিত” । 

মাহমুদুর রহমান মান্নার মতে, এনসিপি-র সমর্থনে সরকারী সহায়তা থাকলেও তা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হয়নি। 

এনসিপি এ অভিযোগগুলি প্রত্যাখ্যান করে দাবী করে, তাদের জনসমর্থন অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী তরুণদের আত্মত্যাগের ফল । তবে তাদের অনুষ্ঠানে প্রত্যাশিত জনসমাগম না হওয়ায় সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।

ব্র্যাকের জরিপ অনুযায়ী, এনসিপির প্রাথমিক জনসমর্থন আছে, কিন্তু নির্বাচনী মাঠে টিকে থাকা কঠিন হবে। 

এনসিপির নেতৃত্বে প্রধানত জুলাই অভ্যুত্থানের সক্রিয় ছাত্রনেতারা রয়েছেন। তাদের বক্তব্যে “সেকেন্ড রিপাবলিক” এবং “গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান”-এর প্রতিশ্রুতি থাকলেও অভ্যন্তরীণ কিছু চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট। যেমনঃ
– নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে প্রায়ই বিএনপি-আওয়ামী লীগের প্রতি তীব্র সমালোচনা থাকে, যা ঐক‌্যমত তৈরীতে বাধা সৃষ্টি করে।
– “বহুত্ববাদ”-কে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হলেও জামায়াতের মতো দলের সাথে মতের মিল থাকায় বিভ্রান্তি তৈরী হয়েছে । 
– তৃণমূল পর্যায়ে কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এখনো তারা অ‌নেকটা পিছিয়ে। এটা তা‌দের সংগঠনগত দুর্বলতার পরিচায়ক। 

সিয়াম মাহমুদের মতো তরুণরা এনসিপিকে “পুরনো রাজনীতির বিকল্প” হিসাবে দেখলেও স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে সন্দিহান । 

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এনসিপির সংস্কার এজেন্ডাকে স্বাগত জানালেও তাদের রাজনৈতিক পরিপক্বতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ভারত ও চীন এনসিপির প্রতি সতর্ক, কারণ তাদের “সেকেন্ড রিপাবলিক” ধারণা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

যদি তারা দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি বিরোধী অবস্থান বজায় রাখে এবং তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় তাহ‌লে তাদের উত্থান হ‌বে সংস্কারবাদী শক্তি হিসেবে।
ত‌বে আদর্শিক অনমনীয়তা এবং জোট গঠনে ব্যর্থতা তাদেরকে প্রভাবহীন করে দিতে পারে। আর য‌দি “কিংস পার্টি” তত্ত্ব সত্যি হয় তাহলে এনসিপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে । 

এনসিপির জন্ম বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতার অভাব এবং নেতৃত্বের ঔদ্ধত্য সমালোচনার মূল লক্ষ্য। সংস্কারের নামে ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়লে এনসিপিও পূর্বসূরী সরকারগুলোর মতো “স্বৈরাচারী” তকমা পেতে পারে। তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে জনগণের আস্থা অর্জন এবং আদর্শিক সততার ওপর।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *