জটিল ও বহুমুখী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা

এম, এ হক
বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিশীলতা একটি “পারফেক্ট স্টর্ম”। অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা (রাজনৈতিক একাধিপত্য, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা) এবং বহিরাগত প্রভাব (চীন-ভারত-মার্কিন দ্বন্দ্ব) এর মিশ্রণে তৈরী। এটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রভাবের একটি জটিল আন্তঃসম্পর্কের ফলাফল। সমাধানের পথে প্রধান বাধা হলো ক্ষমতাসীনদের সংস্কারে অনিচ্ছা এবং বিরোধী দলগুলোর অসম রাজনৈতিক প্রতিযোগীতা।
এই সংকট কাটাতে প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ, স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা।
আমি নিরপেক্ষতা বজায় রেখেই তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ দেওয়ার চেষ্টা করব।
পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে গুরুত্ব দেয় চীন-ভারত-মিয়ানমার অঞ্চলের প্রভাব বলয়ে অবস্থানের কারণে। বাংলাদেশ যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা কি দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নের্তৃবৃন্দ বুঝতে পারছেন? ভারতকে বিপদে ফেলতেই বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে, ঠিক যেমন রাশিয়াকে বিপদে ফেলতে ইউক্রেনে যা করা হয়েছে সেই মডেলে। এসব পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয় যা রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্মকর্তারা ধরতেই পারেন না। তাদেরকে ব্যস্ত রাখা হয় বিভিন্ন ছোটখাটো উষ্কানী আর ভাঁওতা দিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও জঙ্গিবাদের উত্থান বেশ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা খবর ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাড়ানো হচ্ছে। ইসলামিক স্টেট (ISIS) ও আল-কায়েদার সাথে যুক্ত গোষ্ঠীগুলো গ্রামীণ এলাকায় সেল গঠন করছে।
প্রাথমিকভাবে এটি আওয়ামী নিধনের প্রকল্প হলেও এর লক্ষ্য সুদূর প্রসারী। যেমনঃ সামরিক বাহিনীকে বিভিন্নভাবে শক্তিশালী করা হবে,তৈরী হবে বিভিন্ন মিলিশিয়া ও প্রাইভেট ফোর্স। পুলিশকে নিষ্ক্রীয় করে মানুষকে নিজ হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার মানসিকতা তৈরী করা হবে। সাথে সাথে চলবে বিভ্রান্তী তৈরীর কাজ। ভারতের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাংলাদেশকে নিয়ে ভূরাজনীতি বুঝতে পারছে না বলেই মনে হয়। অবশ্য এসব কিছুর জন্য ভারতই দায়ী।
আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ধারনা যে, “চীন-ভারত-মার্কিন প্রতিযোগীতার কারণে বাংলাদেশ “প্রক্সি যুদ্ধের” মঞ্চে পরিণত হতে পারে।”
তবে ইউক্রেন যুদ্ধের সাথে সরাসরি তুলনা যুক্তিযুক্ত নয়, কারণ ইউক্রেনে সরাসরি রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন ও ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক চাপকে পশ্চিমা দেশগুলো কখনো কখনো তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায় (যেমনঃ মানবাধিকার ইস্যু, রপ্তানি নীতির শর্ত)। তবে উভয় ক্ষেত্রেই বৃহৎ শক্তিগুলোর পরোক্ষ হস্তক্ষেপের প্রমাণ মেলে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অস্থিরতাকে সরাসরি যুদ্ধ পরিকল্পনার অংশ বলা যায় না তবে কিছু তত্ত্ব ব্যপকভাবে প্রচলিত। যেমনঃ বাংলাদেশে চীন-ভারত-মার্কিন প্রভাব বিস্তারের লড়াই। বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়ন (জিডিপি বৃদ্ধি, গার্মেন্টস সেক্টর) কিছু শক্তিকে উদ্বিগ্ন করতে পারে। রাখাইন অঞ্চলে অস্থিরতা ও রোহিঙ্গা ইস্যুকে কাজে লাগানোর চেষ্টা। তবে, এসব তত্ত্বের পক্ষে শক্ত প্রমাণের অভাব রয়েছে। “ডীপ স্টেট” জড়িত থাকলে সাধারণত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যকলাপ, মিডিয়া ম্যানিপুলেশনের চিহ্ন দেখা যায়, যা এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে পশ্চিমা দেশগুলো গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি বা পরোক্ষ ভূমিকা রাখার উদাহরণ রয়েছে। যেমনঃ ১৯৭৩-এ চিলির সালভাদর আয়েন্দের পতনে সিআইএ-এর ভূমিকা। ২০১১-এর “আরব স্প্রিং” এ কিছু দেশে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ (লিবিয়া, সিরিয়া)। ইউক্রেনে ২০১৪ সালের ইউরোমাইডান বিপ্লবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন/মার্কিন সমর্থন। যার ফল আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এসব ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে স্থানীয় আন্দোলনকে সমর্থন করেছে।
বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা ভারতের জন্য নিরাপত্তাজনিত দুটি বড় হুমকি। প্রথমটি হচ্ছে রোহিঙ্গা/উপজাতি সংকটের বিস্তার। আর দ্বিতীয়টি হল চীনের প্রভাব বৃদ্ধি (যেমনঃ চট্টগ্রাম বন্দরে চীনা বিনিয়োগ)। এছাড়াও সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র/মাদক পাচার বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক এখনো কূটনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর (১৯৭১-এর ইস্যু)। পাকিস্তানি জাহাজ ঢুকতে দেয়ার ঘটনা যদি সত্য হয়, তবে এর পেছনে সম্ভাব্য কারণ হতে পারেঃ অর্থনৈতিক চাপ (বাংলাদেশের আমদানী-রপ্তানী চাহিদা),
তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা (যেমনঃ চীন)। তবে এ নিয়ে প্রমাণাভাব রয়েছে এবং সরকার এটি অস্বীকার করতে পারে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
ইয়েমেন সংকটে সৌদি জোটকে পাকিস্তানী সেনা সরবরাহের আলোচনা হয়েছিল (২০১৫), যদিও পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নেয়নি। CPEC (চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর) নিরাপত্তায় পাকিস্তানী সেনার ভূমিকা। আফগানিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের দ্বৈত ভূমিকা (সিআইএ-এর সাথে সহযোগীতা ও তালিবানকে সমর্থন)। এগুলোকে কৌশলগত স্বার্থের অংশ।
তবে বাংলাদেশ বিষয়ে বিশ্লেষকরা বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেনঃ “অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরী, কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ তা অসম্ভব করে তুলছে।”
নোয়াম চমস্কি তার এক বিশ্লেষণে প্রকাশ করেছেনঃ “পশ্চিমা দেশগুলোর হস্তক্ষেপ মানবাধিকারের চেয়ে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থেই বেশী।”
জন মিয়ারশাইমারের রিয়ালিস্ট তত্ত্ব অনুযায়ী “বাংলাদেশের গুরুত্ব চীন-ভারত প্রতিযোগিতার কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তৃতীয় শক্তিগুলোকে সক্রিয় করে তুলছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশের সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগীতা বাড়াতে হবে।”
দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, “বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রভাব ফেলবে, যা চীনের BRI পরিকল্পনার জন্য সুবিধাজনক।”
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি একক কোনো কারণ বা শক্তির পরিকল্পনা নয়, বরং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগীতামূলক স্বার্থের জটিল সমন্বয়। প্রমাণের অভাবে “ডীপ স্টেট” বা সরাসরি যুদ্ধ পরিকল্পনার তত্ত্ব নিছক অনুমান হিসেবেই রয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় অভ্যন্তরীণ সংলাপ ও স্বচ্ছতা জরুরী।