কবি আল মাহমুদ

এম,এ হক
লেখাটা কিছুটা বাসী হয়ে গেল। তারপরেও একেবারে কিছু না লিখলেই নয়। যার কথা লিখছি তিনি ছিলেন, একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকার বিরোধী সংবাদপত্র দৈনিক গণকন্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪) পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন।
বিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যে তিনি এক প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিভা। আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহ তাঁর কবিতার বিশেষ উপাদান। তাঁর কাব্যের ভাষা ছিল লোকজ জীবনকেন্দ্রিক। কথাসাহিত্যেও রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। সাহিত্যচর্চার প্রথম দিকে সমাজতন্ত্রের প্রতি ভীষণভাবে আস্থাশীল ছিলেন।
যাক সেসব কথা।
জীবনানন্দ দাসের ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ার পর মীর আব্দুস শুকুর ভাবলেন, আরে, এমন কবিতা তো আমিও লিখতে পারি। যেই কথা, সেই কাজ। একটা কবিতা লিখে ফেললেন। জীবনের প্রথম কবিতাটি পড়তে দিলেন চাচাতো বোন হানুকে।
হানু কবিতাটি পড়ে বললো, “এই কবিতা তো আগে কোথাও পড়েছি!”
বোনের মন্তব্য শুনে তরুণ কবি হাসবেন নাকি কাঁদবেন? তাঁর লেখা কবিতাকে বোন বলছে “আগে পড়েছি”। যেন তিনি এটা কপি করেছেন।
পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ (জন্ম১১ জুলাই ১৯৩৬ – মৃতু্য১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৯) যিনি আল মাহমুদ নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি।
মোল্লা বাড়ীতে জন্ম নেয়া একটা ছেলে বললো- “আমি কবি হতে চাই”। তরুণ বয়সের এই আবেগকে রুখে দেবার জন্য হানু বাধা দিলেন। বললেন, “কবিতা লিখলে ভাত জুটবে কোত্থেকে?”
জীবন সাগরে সাঁতার কাটতে গিয়ে চাচতো বোনের কথাটি বারবার তাঁর মনে পড়ে। তল্পিতল্পাহীন অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় আসেন কবি হবার জন্য।
ঢাকায় এসে জীবিকার সন্ধান করে ঢাকাকেই আপন করে নেন। ঢাকা আর নিজের জন্মস্থানের তুলনা করে বলেন- “যে শহর জন্ম দেয় কিন্তু জীবিকা দেয় না তারচেয়ে যে শহর জীবিকা দেয় তাকে আমার কাছে মাতৃতুল্য মনে হয়।”
সেদিন চাচাতো বোন তাকে ‘কবি’ বলে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের একজন ছিলেন তাঁর চাচী, সেই চাচী তাকে ‘কবি’ বলে ডাকতেন। গ্রামের মানুষরাও তাঁকে ‘কবি’ বলে ডাকতো। অথচ তখনো তাঁর কোনো কবিতা প্রকাশিত হয়নি।
মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করা আল মাহমুদকে একসময় মানুষ ‘বিশ্বাসীদের কবি’ সম্বোধন করে। অথচ জীবনের প্রথমদিকে নিজের বিশ্বাস নিয়ে দোদুল্যমান ছিলেন এই কবি। তাঁর মা বাবাকে অভিযোগ করতেন, “তোমার ছেলে তো বইটই পড়ে নাস্তিক হয়ে গেছে।” বাবা মায়ের কথা কান দিতেন না। তিনি ভাবতেন, ছেলে যদি বিভ্রান্ত হয়। পরে সে অবশ্যই ফিরে আসবে।
আল মাহমুদ জীবনের মধ্যখানে ফিরেও আসেন। ১৯৭৮ সালে হজ্বে যান। হজ্ব করে আসার পর “তথাকথিত” প্রগতিবাদী কবিরা তাঁকে ‘মৌলবাদী’ বলে আখ্যা দেয়। তাদের মৌলবাদী আখ্যাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কবি লিখলেন ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থটি।
এতদিন তাঁর যতো বন্ধু-শুভাকাঙ্খী জুটেছিল, এই কাব্যগ্রন্থ লেখার পর সবাই তাঁর বিরুদ্ধে চলে যায়। এই কাব্যগ্রন্থ তাঁকে আবার নতুন করে ‘মৌলবাদী’ প্রমাণ করিয়ে দেয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তাঁর লেখা প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। যারা সারাদিন বাক স্বাধীনতার কথা বলে চায়ের কাপ গরম করত, সেইসব “তথাকথিত” প্রগতিবাদীদের এমন দ্বৈত নীতি দেখে কবি বেশ মজা পান। তাঁর আত্মজীবনীতে এই নিয়ে লিখেন।
কবি হবার দায় অনেক। আশেপাশের অনেকেই সেটা সহ্য করতে পারেন না। নিজের এমন মনবেদনা নিয়ে কবি লিখেন- “নিজের পক্ষের লোকেরা যখন ক্রমাগত দুঃখের আয়োজন করেন, তখন কবির জন্য অপার্থিব সুখের আয়োজন করেন তার রব।”
জীবনের শেষবেলায় কবি রবের আশ্রয় খুঁজতে থাকেন।
কবি লিখেন:
“কোনো এক ভোর বেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।”
আমরা দো’আ করি জান্নাতে বিশ্বাসীদের পাশে তাঁর স্থান হয়।