আলেকজান্ডারের শেষ ৩টি ইচ্ছা
এম,এ হক
যিশু খ্রীস্টের জন্মের ৩০০ বছরেরও বেশী সময় আগের ঘটনা। পৃথিবী দেখেছিল এক বিশাল মাপের বীরকে। তিনি প্রাচীন গ্রীসের ম্যাসিডনের রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। খ্রীস্টপূর্ব ৩৫৬ সালে তার জন্ম। মাত্র ২০ বছর বয়সে পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের স্থলাভিষিক্ত হন তৃতীয় আলেকজান্ডার। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডারকে বলা হত ‘অর্ধেক পৃথিবীর রাজা’। কারণ গ্রীসের ছোট্ট রাজ্য ম্যাসিডন ছাপিয়ে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী জয় করেছিলেন তিনি। অল্প বয়স হলেও সিংহাসন সামলানো তাঁর পক্ষে কঠিন হয়নি। কারণ, লিওনাইডাসের মত একজন যোগ্য প্রশিক্ষকের কাছ থেকে তিনি শরীর বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন আর মাত্র ১৩ বছর বয়স শিক্ষা পেয়েছিলেন মহান গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের কাছ থেকে। মূলত এই সুশিক্ষার কারণেই আলেকজান্ডার প্রচন্ড শারীরিক দৃঢ়তা ও মেধার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ছেলেবেলায় আলেকজান্ডারের বাবা ফিলিপ বলেছিলেন, ‘ম্যাসিডন বড়ই ছোট তোমার পক্ষে। একদিন সারা পৃথিবী জয় করবে তুমি।’ বাবার সেই কথা সত্যি প্রমাণ করেছিলেন আলেকজান্ডার। তার শাসনামলের বেশিরভাগ সময় তিনি উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়াজুড়ে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি মিসর থেকে শুরু করে উত্তর পশ্চিম ভারত পর্যন্ত ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই আমলের মানচিত্রে চোখ রাখলেই অনুমান করা যাবে কত বড় বীর ছিলেন আলেকজান্ডার। সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালেই বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলই জয় করেন তিনি। কয়েক হাজার বছর আগে মৃত্যু হলেও এই বীরের সমাধি আজও রহস্য আর নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়ে চলেছে মানুষের মনে।
অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন আলেকজান্ডার। অন্য সব রাজার থেকে ছিলেন স্বতন্ত্র। মাথায় সবসময় সিংহের চামড়া জড়িয়ে রাখতেন। মাত্র ৩০ বছরের মধ্যেই অ্যাড্রিয়াটিক সাগর থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার। তাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত তৈরী হতে থাকে নানা রোমাঞ্চকর গল্প। তিনি নাকি সাক্ষাৎ দেবতা জিউসের বংশধর। আলেকজান্ডার নিজেও ভাবতে শুরু করেন তাই। সেই আমলে গ্রিসের দেবী আর্টেমিসের মন্দির ছিল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। আলেকজান্ডারের জন্মের দিন সেটি পুড়ে যায়। কথিত আছে যে, স্বয়ং আর্টেমিস নাকি এসেছিলেন আলেকজান্ডারের জন্মের সাক্ষী হতে। এ রকম নানা কিংবদন্তিতে ভরপুর সম্রাট আলেকজান্ডারের জীবন আলেকজান্ডারের বিশ্ব অভিযান তখন চলছেই। এরই মধ্যে তিনি পারস্য সাম্রাজ্য জয়ের আশায় দারদানেলিস প্রণালী অতিক্রম করেন। এ প্রণালী মরমর সাগর ও এয়িজিন সাগর (অর্থাৎ গ্রিসের পূর্বাংশে ভূমধ্যসাগরের একটি বর্ধিতাংশকে) যুক্ত করেছে। আলেকজান্ডার তিনটি বড় ধরনের যুদ্ধ করে ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বে পারস্য নেতা তৃতীয় ডরিয়াসকে হত্যা করেন। আলেকজান্ডার পারস্যবাসীদের পরাজয় ঘটান ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বে। এরপর তিনি অগ্রসর হন আরও পূর্ব দিকে। ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিকে। যে বা যারাই আলেকজান্ডারের কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, আলেকজান্ডার তাকেই পরাভূত করেন। অভিযান চালিয়ে যেতে মুখিয়ে ছিলেন আলেকজান্ডার। কিন্তু সেনাবাহিনী বাদ সাধল। বিশাল সেনাবাহিনীর বাধার মুখে পূর্বমুখী অভিযান বন্ধ করতে বাধ্য হলেন আলেকজান্ডার।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩-এর মে মাস। সারা বিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া এই বীরের বয়স তখন ৩৩। সিংহাসনে আরোহণের পর এক যুগেরও বেশী সময় কাটিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর অনেকটা জয় করতে। আলেকজান্ডারের স্বপ্ন ছিল, তার বিশাল এ সাম্রাজ্য আরও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটাবেন। কিন্তু তার সে স্বপ্ন কখনোই বাস্তবে রূপ নেয়নি। সেনাবাহিনীর বাধার মুখে কয়েক বছরের সামরিক অভিযান শেষ করে আলেকজান্ডার ফিরে আসলেন বাগদাদে। এই সুযোগে তিনি বিশ্রামে গেলেন। সেই সঙ্গে তার পরবর্তী অভিযানের ছকও আঁকতে লাগলেন। ২৯ জুন তিনি তার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর আমন্ত্রণে এক ভোজসভায় যোগ দেন। দিনব্যাপী এ আয়োজনে আলেকজান্ডার প্রচুর মদ পান করেন। এক সময় অস্বস্তি বোধ করেন। ‘তার ভালো লাগছে না’, এ কথা বলে ঘুমুতে চলে যান আলেকজান্ডার। এক সময় কাঁপুনি দিয়ে প্রচন্ড জ্বর ওঠে। দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে তার। তিনি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েন যে, বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না। বিশ্ব বিজয়ী এই বীর এর ১০ দিন পর মারা যান। তবে আলেকজান্ডারের মৃত্যু নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। ভারতবর্ষ জয় করতে এলে সেখানকারই এক জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ব্যাবিলনই আলেকজান্ডারের শেষ গন্তব্য। ভারতবর্ষ থেকে ব্যাবিলনে যাওয়ার কোনো পূর্বপরিকল্পনা না থাকলেও নিয়তিই যেন তাঁকে সেখানে নিয়ে যায়। সাধারণভাবে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ঘটনা এভাবে বলা হলেও তার মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো অজানা।
মৃত্যুশয্যায় আলেকজান্ডার তাঁর সেনাপতিদের ডেকে বলেছিলেন, “আমার মৃত্যুর পর তিনটা ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে। এতে যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে।” প্রথম অভিপ্রায় ছিল, শুধু চিকিৎসকরাই তাঁর কফিন বহন করবেন। দ্বিতীয় অভিপ্রায় ছিল, তাঁর কফিন যে পথ দিয়ে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথে কোষাগারে সংরক্ষিত সোনা, রূপা ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর ছড়িয়ে দিতে হবে। শেষ ইচ্ছে ছিল, কফিন বহনের সময় তাঁর দুই হাত যেন কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তার মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত লোকজন মহাবীর আলেকজান্ডারের এই অদ্ভুত অভিপ্রায়ে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলেন না কেউ। তখন আলেকজান্ডারের একজন প্রিয় সেনাপতি তার হাতটা তুলে ধরে চুম্বন করে বলেন, “অবশ্যই আপনার সব অভিপ্রায় পূর্ণ করা হবে; কিন্তু আপনি কেন এই বিচিত্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?”
দীর্ঘ একটা শ্বাস গ্রহণ করে আলেকজান্ডার বললেন, “আমি দুনিয়ার সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই।
আমার চিকিৎসকদের কফিন বহন করতে বলেছি এই কারণে যে, যাতে মানুষ অনুধাবন করতে পারে চিকিৎসকরা আসলে কোনো মানুষকে সারিয়ে তুলতে পারেন না। তারা ক্ষমতাহীন আর মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম।
গোরস্থানের পথে সোনা-দানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি কারণ মানুষকে এটা বোঝাতে যে ঐ সোনা-দানার একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি, কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না।
মানুষ বুঝুক ধন-সম্পদের পেছনে ছোটা সময়ের অপচয় মাত্র। কফিনের বাইরে আমার হাত ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা জানাতে যে খালি হাতে আমি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম, আবার খালি হাতেই পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি।”