আমরা কি পারব?

এম,এ হক
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর নতুন নেতৃত্ব বা অংশগ্রহণকারীদের স্বেচ্ছাচারী আচরণের সম্ভাবনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনার একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা সরকারের পতন-পরবর্তী সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণে নিম্নলিখিত দিকগুলো বিবেচ্যঃ
ক্রেন ব্রিনটনের (বিপ্লবের চক্র) মতে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান প্রায়ই নতুন একটি “অভিজাত গোষ্ঠী” তৈরী করে, যারা ক্ষমতায় এসে পুরনো শাসকদের চেয়েও বেশী নিপীড়নমূলক হতে পারে (যেমন মিশরে ২০১১-এর বিপ্লব-পরবর্তী সামরিক শাসনের পুনরুত্থান)। বাংলাদেশের ইতিহাসেও ১৯৭৫-পরবর্তী ঘাতকচক্রের উত্থান বা ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত এই চক্রের উদাহরণ। তাঁর দ্যা এনাটমি অফ রেভ্যুলুশান (১৯৩৮)-এ ব্যাখ্যা করেন যে বিপ্লবগুলোর প্রায়ই একটি “আদর্শিক উগ্রতা” ও “তাপসন্ধানী প্রতিক্রিয়া” পর্যায় থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ফরাসি বিপ্লবের পর রোবসপিয়েরের “সন্ত্রাসের রাজত্ব” বা রুশ বিপ্লবের পর স্ট্যালিনের স্বৈরশাসন। তাঁর মতে, ক্ষমতায় আসীন বিপ্লবীরা প্রায়ই পুরনো শাসকদের চেয়েও নিপীড়নমূলক হয়ে ওঠে, কারণ তারা “প্রতিবিপ্লবী শক্তির ভয়” ও “নতুন ব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে” চরমপন্থার আশ্রয় নেয়।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান (নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার) দুর্বল হলে ক্ষমতার শূন্যতা পূরণে নতুন নেতৃত্ব জরুরী আইন, সেনা বা প্রশাসনিক দমন-পীড়নের আশ্রয় নিতে পারে। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় “সুশাসনের নামে” মানবাধিকার লঙ্ঘন এর একটি উদাহরণ।
স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর পলিটিক্যাল অর্ডার ইন চেঞ্জিং সোসাইটিজ (১৯৬৮)-এ উল্লেখ করেন যে, শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরী হয়। এই শূন্যতা পূরণ করতে গিয়ে বিপ্লবীরা প্রায়ই জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তিনি জোর দেন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ-এর উপর। যদি নতুন নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান (যেমন নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন মিডিয়া) গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, তবে স্বৈরাচারের পুনরাবৃত্তি অনিবার্য।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, নেতৃত্বের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এবং বিরোধী দলের প্রতি সহিষ্ণুতার অভাব নতুন নেতৃত্বকেও স্বেচ্ছাচারী করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৬ বা ২০০৮ সালে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারগুলোর শুরুতে গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি থাকলেও পরবর্তীতে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা দেখা গেছে।
হেন্নাহ আরেন্ড তাঁর অন রেভ্যুলুশান (১৯৬৩)-এ যুক্তি দেন যে, বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করে “সরকারের নতুন রূপ তৈরী করার” উপর, শুধু পুরনো ব্যবস্থা ধ্বংস করার উপর নয়। তিনি আমেরিকান বিপ্লব (প্রাতিষ্ঠানিক সংবিধান নির্মাণ) ও ফরাসী বিপ্লবের (রক্তাক্ত আদর্শবাদ) মধ্যে পার্থক্য টানেন। তাঁর মতে, আদর্শের নামে সহিংসতা ও দমন-পীড়ন বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যকে বিকৃত করে। ভিলফ্রেডো পারেতোর “অভিজাতদের চক্রতত্ত্ব” অনুযায়ী, বিপ্লব কেবল ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটায়, কাঠামোগত পরিবর্তন নয়। নতুন নেতৃত্ব প্রায়ই পুরনো শাসকদের মতোই দুর্নীতি ও নিপীড়নে জড়িয়ে পড়ে, কারণ ক্ষমতার প্রকৃতি অপরিবর্তিত থাকে। যেমন মাও-পরবর্তী চীনে কমিউনিস্ট পার্টির অভিজাতরা অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করে।
দা স্কচপোল তাঁর স্টেটস্ এন্ড সোশ্যাল রেভু্যলুশানস (১৯৭৯)-এ দেখান যে, বৈদেশিক চাপ (যুদ্ধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা) নতুন সরকারকে কর্তৃত্ববাদী হতে বাধ্য করতে পারে। যেমন, ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পর মার্কিন চাপের মুখে আয়াতুল্লাহ সরকার বিরোধীদলীয় দমনকে “জাতীয় নিরাপত্তা” হিসেবে ন্যায্যতা দেয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। নতুন নেতৃত্ব যদি সেনা বা আমলাতন্ত্রের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তবে তাদের স্বার্থ রক্ষায় স্বৈরাচারী পন্থা গ্রহণের ঝুঁকি থাকে (যেমন ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা)।
যদি অভ্যুত্থান-পরবর্তী নেতৃত্ব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করে (যেমনঃ স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মিডিয়ার স্বাধীনতা, যুব ও নারীদের অংশগ্রহণ) তবে স্বৈরাচারের পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব। দক্ষিণ আফ্রিকার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সত্য ও সমঝোতা কমিশন (TRC) এবং সংবিধান প্রণয়ন এই দৃষ্টান্ত তুলে ধরে।
যদি নতুন নেতৃত্ব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, বিরোধী মত দমন করে বা আইনের শাসনকে উপেক্ষা করে, তবে তা পুরনো স্বৈরাচারের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। মিয়ানমারে অং সান সু চির সরকারের পতন এবং সামরিক জান্তার পুনরুত্থান এর সাম্প্রতিক উদাহরণ।
হেন্নাহ আরেন্ড সতর্ক করেন যে, “বিপ্লবের সাফল্য শুধু ক্ষমতা দখলে নয়, নতুন রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণে”। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর অর্থ হলো—সংসদীয় ব্যবস্থাকে কার্যকর করা, নাগরিক সমাজকে শক্তিশালী করা, এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। দা স্কচপোল বলেছেন, “বিপ্লব-পরবর্তী সরকার বৈদেশিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলায় কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে পারে”। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট, জলবায়ু সমস্যা বা ভারত-চীন-মার্কিন কূটনৈতিক চাপ নতুন নেতৃত্বকে কর্তৃত্ববাদী নীতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
প্রধান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাবের পুনরাবৃত্তি এড়াতে প্রয়োজনঃ শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ।
সফল গণঅভ্যুত্থান (যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন) প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও সমন্বয়ের মাধ্যমে স্বৈরাচার প্রতিরোধ করেছে। অন্যদিকে, মিশর বা জিম্বাবুয়ের মতো দেশে বিপ্লব-পরবর্তী নেতৃত্ব পুরনো শাসনের চেয়েও নিপীড়নমূলক হয়েছে। তাই বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করে তার রূপান্তরমূলক রাজনৈতিক কাঠামো তৈরী করার ক্ষমতার উপর।
বাংলাদেশের মতো দেশের প্রেক্ষাপটে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গঠন জরুরী। ইতিহাস দেখায়, শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার সরকারই হোক—ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বাংলাদেশকে বারবার স্বৈরাচারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাই, “বিপ্লবের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ শুধু একটি সরকারের পতন নয়, একটি ব্যবস্থার পরিবর্তন”।