অস্থির বাংলা

এম,এ হক
বাংলাদেশে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক উত্তেজনা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব অব্যাহত থাকে, তবে দেশটির ভবিষ্যৎ নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি গার্মেন্টস্ শিল্প, রেমিট্যান্স এবং কৃষির ওপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে, মুদ্রার মান হ্রাস (টাকার অবমূল্যায়ন) এবং বেকারত্ব বাড়াতে পারে। বৈদেশিক ঋণ ও রিজার্ভের চাপও বাড়তে পারে। ২০২৩-২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতি ৯%-এর কাছাকাছি পৌঁছানোয় নিম্ন-মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা সংকটাপন্ন।
স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতেঃ “আধুনিকায়নের গতির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোজন ব্যর্থ হলে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।” বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এই উক্তির সাথে যথাযথ মিল রয়েছে। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও রাজনৈতিক সংস্কার (যেমন: নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন) দুর্বল থাকায় সংকট তৈরি হয়েছে।
নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনে আস্থাহীনতা বাড়লে দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী প্রবণতা বাড়তে পারে। আমাদের দেশে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকা না থাকায় গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা দুর্বল। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা এ সম্বন্ধে বলেছেনঃ “সামাজিক আস্থা” ছাড়া কোনো দেশ টেকসই উন্নয়ন করতে পারে না”। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি বিদ্বেষ-ঘৃণা ও মিডিয়ার বিভাজন সামাজিক আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দুর্নীতি দমন ও নাগরিক সেবার মানোন্নয়নে ডিজিটাল গভর্ন্যান্স জোরদার করা অতীব জরুরী।
রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে চরম মেরুকরণ এবং ধর্ম-জাতিগত উত্তেজনা (যেমন: সংখ্যালঘু নিরাপত্তা) সামাজিক সংহতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা শিক্ষার্থী আন্দোলনে পুলিশি দমন-পীড়নের ঘটনা সামাজিক অবিশ্বাস বাড়াচ্ছে। ডারন অ্যাসিমোগ্লু ও জেমস রবিনসনের মতেঃ “নিষ্কাষণমূলক প্রতিষ্ঠান”দেশকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যায়।” বাংলাদেশে ক্ষমতা ও সম্পদের কেন্দ্রীকরণ (পারিবারিক রাজনীতি, ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি) অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বাধা। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলির মূল উদ্দেশ্য হল সমাজের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে সম্পদ ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা। এগুলি সাধারণত অগণতান্ত্রিক, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং জনগণের অংশগ্রহণকে সীমিত করে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের অভিযোগে পাশ্চাত্য দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন (যেমন: মার্কিন ভিসা নীতির কঠোরতা) বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতায় প্রভাব ফেলতে পারে। এটি সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থানের মতো নয়, বরং আইনের আড়ালে গণতন্ত্রকে দুর্বল করার প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, নিয়ম ও মূল্যবোধের ক্ষয় হওয়া। আরেন্ড লিজফার্ট বলেছেনঃ “সহযোগিতামূলক গণতন্ত্র”-এর মাধ্যমে মেরুকরণ কমিয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগির পরামর্শ দেন”।
আসলে বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) মধ্যেকার শূন্যতা পূরণে তৃতীয় শক্তির বিকাশ প্রয়োজন।
বাংলাদেশে সত্যিকারের কোনো মেধার বিকাশ নেই। আর যারা মেধাবী তাদের মধে্য দেশত্যগের প্রবণতা প্রবল। কারণ উচ্চ শিক্ষিত মেধাবীদের কর্মসংস্থানের অভাব এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তাদের অংশগ্রহণ না থাকায় বিক্ষোভ বা দেশত্যাগের প্রবণতা বাড়ে। ড. রওনক জাহান-এর মতে, বাংলাদেশে “গণতন্ত্রের হাইব্রিড মডেল” (নির্বাচনী একনায়কত্বের প্রবণতা) স্থিতিশীলতার বদলে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করে”। বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। আবার অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, “রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না হলে প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কার সম্ভব নয়।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও ক্লাইমেট ভালনারেবল দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। যদি বর্তমান সংকটের সমাধান না হয়, তবে দেশটি “মধ্য আয়ের ফাঁদ” থেকে “রাজনৈতিক ফাঁদ“-এ আটকে যেতে পারে, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অস্থিরতার কারণে ধ্বংস হবে। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা রয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ আশাবাদী।