অনাকাঙ্খিত ভবিষ্যৎ
এম, এ হক
১লা জুলাই থেকে শুরু হওয়া সারা বাংলাদেশে বিস্ফোরক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন এবং তাকে নয়াদিল্লিতে পালাতে বাধ্য করা ছাত্রদের এই বিক্ষোভ দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করেছে, যার আনুমানিক মূল্য কয়েক বিলিয়ন ডলার।
কিন্তু এই আন্দোলন কি শুধুই ছাত্রদের ছিল নাকি ক্ষমতালিপ্সু কিছু ব্যাক্তি অথবা সংগঠন এর পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছিল? দেশের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেই তার কিছু আলামত আমরা পেতে পারি। শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর গণভবনে ঢুকে আন্দোলনকারীরা যেভাবে লুটতরাজ শুরু করল তা দেখে কে বলবে আমরা সভ্য জাতি। একটা ভবনে রক্ষিত সামান্য কিছু দ্রব্যাদির লোভই তারা সামলাতে পারল না আর যদি দেশের সর্বময় ক্ষমতা তাদের হাতে ন্যাস্ত হয় তাহলে না জানি তারা কি করবে?
“জলের গানে”র রাহুল আনন্দ প্রথম থেকেই আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে গিয়ে তাদের পক্ষে গানও গেয়েছেন।
কিন্তু তার ধানমন্ডির বাসস্থানে হামলা হয়। হামলাকারীরা তার সব গানের ইন্সট্রুমেন্ট ভেঙে ফেলে ও বাসা তছনছ করে। শেষে এক কাপড়ে তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়।
শিল্পী হোক বা সাহিত্যিক হোক ন্যুনতম রাজনৈতিক দূরদর্শিতা না থাকলে তার পরিণতি ভোগ করা লাগে।
নিশ্চয়ই এবার সংহতি ও একাত্মতার সুখের সমাপ্তি ঘটেছে, মোহভঙ্গ হয়েছে।
কোটা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়করা ভেবেছিল তাদের ডাকে মানুষ সরকার পতন ঘটিয়েছে। ভুল।
আজকে যে নদীতে লাশ ভাসছে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে কঙ্কাল করে ফেলা হচ্ছে, সারাদেশে খুন, লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে তারা কি এখন বারবার আহ্বান জানিয়েও এসব থামাতে পারছে?
এই মুহূর্তে দেশে এমন কোন ব্যক্তিত্ব আছে এসব থামাতে পারবে?
সবাই থামানোর জন্য বলছে, কেউ শুনছে?
আজ শুনছি পতনের পর মৃত্যুর সংখ্যা হাজার নাকি ছাড়িয়ে গেছে।
শাহীন চাকলাদারের হোটেলে অগ্নিসংযোগে স্টাফ ও অতিথিসহ আটাশ জনের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এসবের জন্য কারা দায়ী বা এসবের বিচার কে করবে, কেউ দাবী তুলছে না। এসবের কোনদিন বিচারও হবে না।
কোটা আন্দোলনকারীরা একদিন বুঝবে এ বিজয় যেমন তারা ধরে রাখতে পারবে না, তেমনি এর ফলও তাদের হবে না। সবকিছু চলবে গতানুগতিক বা আরও খারাপ ভাবে। সেজন্য এতগুলো প্রাণের অপচয়ও মেনে নেওয়া যায় না।
বঙ্গবন্ধু সিনিয়রিটি ডিঙ্গিয়ে কে এম সফিউল্লাকে সেনাপ্রধান বানিয়ে পরিবারসহ শেষ হয়েছিল। শেখ হাসিনাও সেই ভুল করলেন।
এ প্রেক্ষিতে উরুগুয়ের প্রখ্যাত কবি ও সাংবাদিক এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোর একটি উক্তি মনে পড়ে গেল, “ইতিহাস কখনোই ‘বিদায়’ বলে না, ইতিহাস বলে পরে দেখা হবে।”
পলাশীর ঘটনা মনে পড়ে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর প্রজারা রাস্তায় বেরিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছিল। তাকে ধরে বেঁধে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় উল্লাস করছিল। ইংরেজরা অবাক। কোন প্রতিরোধ বা দুঃখের বদলে জনতা উল্লসিত। ইংরেজরা সন্দিহান এরা কি বিকৃত মস্তিস্কের না পাগল। নিজের মান সম্মান ভালোমন্দও বুঝে না?
ইংরেজরা সেদিনই বুঝেছিল এদের পূর্বাপর ভাবার জ্ঞান নেই এরা অনৈতিক ও তামাশা প্রিয়।
ব্রিটিশ শাসনের কিছুদিনের মধ্যেই তারা তাদের উল্লাসের পরিণতি টের পেয়েছিল। বুঝেছিল স্বাধীনতা পেয়েছিল না হারিয়েছিল।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মিলিটারি ক্ষমতার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী মিলিটারি নিয়ন্ত্রিত অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার থাকবে।
কতদিন যাওয়ার পর শুরু হবে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব। বিএনপি চাইবে তাড়াতাড়ি নির্বাচন। কারণ তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ বেশী। বাকী দলগুলো সবাই মিলে জোটগতভাবে ভোটে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে না। তাই তারা চাইবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দীর্ঘমেয়াদে থাকুক।
জাতীয় পার্টি অলরেডি বলে দিয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ ঠিক করতে অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকুক।
আস্তে আস্তে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়বে। গণতন্ত্র, নির্বাচন, সুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম সবকিছু ধূলিসাৎ হবে। এরকম পুতুল সরকার বাইরের অনেক পরাশক্তি চায়। তাহলে চাপ দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করা যায়।
হয়ত তাই ঘটতে যাচ্ছে এই তামাশাপ্রিয় অনৈতিক জাতির উপর।
কিংবদন্তি প্রফেসর রাজ্জাককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি?
খেপে গিয়ে বলেছিলেন, “সবার ভবিষ্যৎ থাকতে হবে কেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেন থাকবে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেই”।
তার কথাটি হয়ত পছন্দ হয়নি। এতদিন আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তিনিই সঠিক। এত প্রজ্ঞাবান মানুষ নিজ জাতির চরিত্র অবলোকনে ভুল করতে পারেন না।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অবলোকন করলেই অনেকাংশে অনুধাবন করা যায় এ দেশের ভবিষ্যৎ কি?